"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
ইগলু: বরফ দিয়ে বানানো বরফের ঘর

ইগলু কে না চেনে? দেখা যাবে যে কিনা রুই মাছ চেনে না কিন্তু ইগলু ঠিকই চেনে। না চিনলেও কোথাও না কোথাও দেখেছে। এর পেছনে একটা বড় অবদান আছে কার্টুন চ্যানেলের। ইগলু হচ্ছে সাদা সাদা গোল গম্বুজের মতো বরফের তৈরি ঘর- বরফের দেশে থাকার জন্য। কিন্তু বরফ দিয়ে বানানো এই ঘর কি করে মানুষের আশ্রয় হতে পারে?

আমাদের দেশে অল্প শীত পড়ে। বরফ পড়ার মত শীত না। তবু শীতকালে সিমেন্টের পুরু দেয়ালের ঘরে বসেও কাঁপতে হয়। আর এদিকে বরফ দিয়ে বানানো গোলাকার ইগলু ঘরে মাইনাস ডিগ্রী তাপমাত্রাতেও সহজভাবে থাকছে মানুষ।
কিন্তু কিভাবে? সাইন্সটা কি? চলুন আরেকবার ঝালাই করে নেয়া যাক।
আপেক্ষিক তাপ (Specific heat)
দুনিয়ার সব কিছুরই আপেক্ষিক তাপ বলে একটা জিনিস আছে। এটা হচ্ছে পদার্থের তাপ সংক্রান্ত একটা বৈশিষ্ট্য। সোজা ভাষায় বললে, এক কেজি ভরের কোনো পদার্থের (যেমন: পানি, লোহা, কাঠ ইত্যাদি) তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বাড়াতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হয় সেটাই ঐ পদার্থের আপেক্ষিক তাপ।
ধরেন, এক কেজি ভরের পানি আপনি চুলার উপরে দিলেন। একটা থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা মাপলেন। তারপর দিয়াশলাই দিয়ে আগুন জ্বালালেন। পানি কিছুটা গরম হলে, তাপমাত্রা মেপে দেখলেন এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। এবার চুলা বন্ধ করে দেন। তাহলে চুলার যে পরিমাণ তাপ খরচ হলো এই এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য- সেটাই হচ্ছে পানির আপেক্ষিক তাপ।
যেমন: ১ কেজি পানির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী বাড়াতে ৪২০০ জুল শক্তি (এখানে তাপশক্তি) প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ পানির আপেক্ষিক তাপ হলো ৪২০০ J/kgK (এটা হচ্ছে আপেক্ষিক তাপের একক)। যেহেতু সব পদার্থ একই পরিমাণ তাপে একই রকমের উত্তপ্ত হয় না, কোনোটা তাড়াতাড়ি কোনোটা দেরি করে গরম হয়, তাই সব পদার্থের আলাদা আলাদা কম বেশি আপেক্ষিক তাপ আছে।

এখন এই আপেক্ষিক তাপটা কি কাজে লাগে? আর বরফের ইগলুর সাথেইবা এর সম্পর্ক কি?
ধরা যাক, এক জায়গায় রোদের মধ্যে দুটো বেঞ্চ রাখা। একটা লোহার, আরেকটা কাঠের। দুইটার উপরেই রোদের আলো পড়ছে। এখন আপনাকে যদি কোনো একটার উপর বসতে বলা হয় আপনি কোনটার উপর বসবেন? আপনার যদি কমনসেন্স থাকে তাহলে কাঠের বেঞ্চের উপর বসবেন। কারণ লোহার বেঞ্চটা যে কাঠের বেঞ্চের তুলনায় অনেক বেশি গরম হয়ে রয়েছে এটা হাত না দিয়েও বোঝা যায়।

এটা ঘটেছে কারণ কাঠের আপেক্ষিক তাপ বেশি (১৫০০)। অন্যদিকে লোহার আপেক্ষিক তাপ তুলনামূলকভাবে কম (৪৫০)। তারমানে ১ কেজি কাঠের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়াতে হলে ১৫০০ জুল তাপ লাগবে। আবার একই পরিমাণ লোহার একই পরিমাণ তাপমাত্রা বাড়াতে ৪৫০ জুল তাপ লাগবে- যা কাঠের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ একই পরিমাণ রোদের আলোতে লোহার বেঞ্চটা কাঠের বেঞ্চের প্রায় তিনগুণ বেশি উত্তপ্ত হয়ে আছে।
আজকের জন্য আপেক্ষিক তাপতত্ত্ব এ পর্যন্তই থাক। চলুন এবার একটা ইগলু ঘর বানানো যাক। কিন্তু বানাতে চাইলেই তো বানানো যায় না। আমাদের তো ঘর বানাবার কাঁচামাল লাগবে। ইগলুর প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে তুষার- আমাদের এখন তুষার জড়ো করতে হবে।
বরফ আর তুষার কি একই জিনিস?
খালি চোখে বরফ আর তুষার প্রায় একই জিনিস। এরা উভয়েই পানি থেকে তৈরি এবং ঠান্ডা। কিন্তু কানাডাতে আকাশ থেকে পড়া তুষার আর আপনার ফ্রিজের ভেতর পানি জমিয়ে তৈরি করা বরফের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।


বরফ হচ্ছে তরল পানি যখন ঠান্ডা হয়ে জমাট বাঁধে সেই কঠিন আহারেঅবস্থা। এতে পানির অনুগুলো নিজেদের মধ্যে সুশৃংখলভাবে যুক্ত হয়ে শক্ত কাঠামো তৈরি করে। অন্যদিকে, তুষার হচ্ছে মেঘের মধ্যে পানির জলীয় বাষ্প যখন ঠান্ডায় জমাট বাঁধে তখন তৈরি হয়। সরল কথায়, পানি জমে বরফ হয়, জলীয় বাষ্প জমে হয় তুষার। বরফ সাধারণত কঠিন, স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ স্ফটিক আকারে হয়, আর তুষার সাধারণত নরম, হালকা এবং নমনীয় হয়।
বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলতে গেলে, বরফের ভেতর পানির অনু ছাড়া অন্য কিছু থাকে না। কিন্তু তুষারের ভেতর অনেক বায়ুকণা থাকে। আর বায়ুকণা মানেই হচ্ছে বাতাস। অর্থাৎ তুষারের ভেতর অনেক বাতাস থাকে- অন্তত বরফের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বাতাস থাকে। এখানেই তুষার আর বরফের পার্থক্য।
তাহলে এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যা যা জানলাম তার একটা তালিকা করা যায়:
১) কোনো পদার্থ কত তাড়াতাড়ি বা কত দেরিতে উত্তপ্ত হবে সেটা নির্ভর করে ওই পদার্থের আপেক্ষিক তাপ এর উপর। যে পদার্থের আপেক্ষিক তাপ বেশি সে তত ধীরে উত্তপ্ত হবে বা তাপ হারাবে। অর্থাৎ কোন পদার্থের আপেক্ষিক তাপের উপর নির্ভর করে সেটা তাপ পরিবাহী বা কুপরিবাহী হবে।
২) বরফ আর তুষার একই রকম মনে হলেও দুইটার গঠনে ভিন্নতা আছে। তুষারের ভেতর অনেক বেশি বায়ু প্রকোষ্ঠ থাকে।
এবার সত্যি সত্যি একটা ইগলু তৈরি করা যাক
ইগলু তৈরি করার জন্য আমাদের প্রথমেই বেশ অনেকটা পরিমাণ তুষার নিতে হবে। ইগলু তৈরীর মূল কাঁচামাল হচ্ছে তুষার।



ইগলু তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ সরল। প্রথমেই তুষারকে চাপ দিয়ে ব্লক বানাতে হয়। অনেকটাই ইটের মতো। বা বড় বড় তুষারখন্ড ছুরি দিয়ে কেটে বড় বড় ইটের আকৃতি দেয়া হয়। তারপর মাটিতে (বরফে) বৃত্তাকারে সেই ব্লগগুলো স্থাপন করা হয়। এক সারি তুষার ব্লক দিয়ে বৃত্ত বানানোর পর, এর উপরে আরেক সারি তুষারের ব্লক দেয়া হয়- অনেকটা ইটের মতোই। কিন্তু পার্থক্য এই যে উপরের ব্লকের সারিগুলো ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে ভেতরের দিকে সরে আসে- ফলে একেবারে উঁচুতে একটা গম্বুজ আকৃতি তৈরি হয়। এই গম্বুজাকৃতির জন্য এই ঘরগুলো বেশ মজবুত হয়। তারপরে এর দেয়ালে একটা গর্তের মতো করা হয় যেটা দরজার কাজ করবে। সবশেষে কোথাও কোনো ফাঁকা থেকে থাকলে সেটা তুষার দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। ইগলুর উপরের ছাদে একটি ছিদ্র থাকে অনেকটা ভেন্টিলেটরের মতো। এক ইগলু থেকে অন্য এগুলোতে যাওয়ার জন্য সুরঙ্গমতো থাকে। এরকম একটা ইগলু বানাতে এস্কিম অধিবাসীদের দুই থেকে তিন ঘন্টা লাগে।
ইগলুর তিনটি অংশ থাকে। একেবারে উঁচুতে মানুষ থাকে আর নিচের অংশে পানি থাকে। মাঝখানে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা। বাতাসের একটা ধর্ম হলো- গরম বাতাস হালকা হওয়ায় উপরের দিকে উঠে যায়, ঠাণ্ডা বাতাস নিচে নামে। তাই মানুষ থাকা উপরের অংশ গরম থাকে।
তাহলে এত পড়াশুনা করলাম কি জন্য?
ইগলু কিভাবে কাজ করে
ইগলু বানানো হয় তুষার দিয়ে। তুষারের ভেতর বাতাসের অনু জমে থাকে। আর যেহেতু বাতাসের আপেক্ষিক তাপ ১০০৫ J/kgK, তাই বাতাস সহজে তাপ পরিবহন করে না। অর্থাৎ বাতাস তাপ কুপরিবাহী। এজন্য ইগলুর বাইরের তাপ ভেতরে কিংবা ভেতরের তাপ বাইরে যেতে পারে না। এছাড়া ইগলুর দেয়াল ভেতরের পরিবেশকে বাইরের বায়ুপ্রবাহ থেকে আলাদা রাখে। এর উপর, মানবদেহ সবসময় শ্বসন প্রক্রিয়ায় তাপ উৎপন্ন করছে। যেহেতু সেই তাপ ইগলুর জন্য বাইরে যেতে পারে না, তাই ইগলু আরো উষ্ণতর হতে থাকে। তাছাড়া, আগুন জ্বালানোর মাধ্যমে ইগলুর ভিতরে তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ানো যায়।

এই ইগলু ঘর কতটা কাজের?
ধরা যাক, আপনি বরফের দেশে গিয়ে দেখলেন তাপমাত্রা -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিছুটা দূরেই দেখলেন একটা ইগলু ঘর। ইগলুর ভিতরে গিয়ে দেখলেন অনেকটাই উষ্ণ। তাপমাত্রা মেপে দেখলেন ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মতো। মানে আমাদের দেশের মাঝারি ঠাণ্ডার মতো।
তো এই তো। এবার নিজেই নিজের ইগলু তৈরী করে উপভোগ করুন আরামদায়ক উষ্ণতা।