বৈশাখী প্রিয় কবিতা উৎসব – নীলাঞ্জনা অদিতির সাথে

কবিতা প্রেমের রাজধানী। এই প্রেম শুধুমাত্র কপোত-কপোতীর প্রেম না। কবিতা সবার আগে মানুষকে নিজের  প্রেমে মজতে শেখায়। কবিতা অসময়ে ছায়া দেয়, সুসময়ে ছায়া দিতে শেখায়। কবিতা মানুষের বুকের ভেতরের কথা বলে।

পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো। মাত্র একদিনের নোটিশে এই আয়োজন আমরা করতে চেয়েছিলাম। ভয়, শঙ্কা দুটোই ছিলো। কিন্তু আপনাদের উৎফুল্ল অংশগ্রহণ আমাদের শুধু সাহস যোগায়নি, দিয়েছে অনুপ্রেরণাও। আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আমাদের এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

আজকে থাকছে নীলাঞ্জনা অদিতি-এর প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আয়োজন। আশা করি তার প্রিয় কবিতাগুলো আপনাদেরও ছুঁয়ে যাবে।

নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি এ প্রভাতে রবির কর
             কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর,
      কেমনে  পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
             জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে       উথলি উঠেছে বারি,
ওরে       প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
                থর থর করি কাঁপিছে ভূধর,
                শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
                ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
                গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
                হেথায় হোথায় পাগলের প্রায়
                ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় –
বাহিরেতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
                কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন,
                চারি দিকে তার বাঁধন কেন!
                ভাঙ্ রে হৃদয়, ভাঙ্ রে বাঁধন,
                সাধ্ রে আজিকে প্রাণের সাধন,
                লহরীর পরে লহরী তুলিয়া
                আঘাতের পরে আঘাত কর্।
                মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
                কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ!
                উথলি যখন উঠেছে বাসনা
                জগতে তখন কিসের ডর!

                আমি    ঢালিব করুণাধারা,
                আমি    ভাঙিব পাষাণকারা,
                আমি    জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
                            আকুল পাগল-পারা।
                কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
                রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।
                শিখর হইতে শিখরে ছুটিব,
                ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।
এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর,
এত সুখ আছে, এত সাধ আছে – প্রাণ হয়ে আছে ভোর।।
কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ –
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
                ওরে, চারি দিকে মোর
                এ কী কারাগার ঘোর –
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
ওরে আজ     কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।

Poem divider

অনন্ত প্রেম – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী,
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া
তোমারি মুরতি এসে,
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগল প্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা
কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে,
মিলনমধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চিরদিবসের প্রেম
অবসান লভিয়াছে
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ,
নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে
সকল প্রেমের স্মৃতি—
সকল কালের সকল কবির গীতি।

Poem divider

সোনার তরী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
     কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
            রাশি রাশি ভারা ভারা
            ধান কাটা হল সারা,
            ভরা নদী ক্ষুরধারা
                    খরপরশা।
     কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
     একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
     চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
            পরপারে দেখি আঁকা
            তরুছায়ামসীমাখা
            গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
                    প্রভাতবেলা–
     এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
     গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
            ভরা-পালে চলে যায়,
            কোনো দিকে নাহি চায়,
            ঢেউগুলি নিরুপায়
                    ভাঙে দু-ধারে–
     দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,
     বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
            যেয়ো যেথা যেতে চাও,
            যারে খুশি তারে দাও,
            শুধু তুমি নিয়ে যাও
                    ক্ষণিক হেসে
     আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
     যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
     আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি ভরে।
            এতকাল নদীকূলে
            যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
            সকলি দিলাম তুলে
                    থরে বিথরে–
     এখন আমারে লহ করুণা করে।
     ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী
     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
            শ্রাবণগগন ঘিরে
            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
            শূন্য নদীর তীরে
                    রহিনু পড়ি–
     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

Poem divider

বাঁশি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কিনু গোয়ালার গলি।
                   দোতলা বাড়ির
               লোহার-গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর
                       পথের ধারেই।
        লোনা-ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি,
               মাঝে মাঝে স্যাঁতা-পড়া দাগ।

মার্কিন থানের মার্কা একখানা ছবি
           সিদ্ধিদাতা গণেশের
                   দরজার ‘পরে আঁটা।
           আমি ছাড়া ঘরে থাকে আরেকটা জীব
                   এক ভাড়াতেই,
                       সেটা টিকটিকি।
                   তফাত আমার সঙ্গে এই শুধু,
                       নেই তার অন্নের অভাব।
বেতন পঁচিশ টাকা,
    সদাগরি আপিসের কনিষ্ঠ কেরানি।

খেতে পাই দত্তদের বাড়ি
              ছেলেকে পড়িয়ে।
        শেয়ালদা ইস্টিশনে যাই,
           সন্ধেটা কাটিয়ে আসি,
        আলো জ্বালাবার দায় বাঁচে।
এঞ্জিনের ধস্‌ ধস্‌,
        বাঁশির আওয়াজ,
           যাত্রীর ব্যস্ততা,
               কুলি-হাঁকাহাঁকি।
                   সাড়ে দশ বেজে যায়,
           তার পরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।

ধলেশ্বরীনদীতীরে পিসিদের গ্রাম।
        তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
           লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল–
        সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।

মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,
           আমি তথৈবচ।
ঘরেতে এল না সে তো, মনে তার নিত্য আসাযাওয়া–
           পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। 

        বর্ষা ঘন ঘোর।
    ট্রামের খরচা বাড়ে,
মাঝে মাঝে মাইনেও কাটা যায়।
           গলিটার কোণে কোণে
        জমে ওঠে পচে ওঠে
               আমের খোসা ও আঁঠি, কাঁঠালের ভূতি,
                          মাছের কান্‌কা,
মরা বেড়ালের ছানা,
        ছাইপাঁশ আরো কত কী যে!
    ছাতার অবস্থাখানা জরিমানা-দেওয়া
               মাইনের মতো,
                   বহু ছিদ্র তার।

           আপিসের সাজ
    গোপীকান্ত গোঁসাইয়ের মনটা যেমন,
               সর্বদাই রসসিক্ত থাকে।
                   বাদলের কালো ছায়া
               স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে
                   কলে-পড়া জন্তুর মতন
                       মূর্ছায় অসাড়।
    দিন রাত মনে হয়, কোন্‌ আধমরা
জগতের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।

    গলির মোড়েই থাকে কান্তবাবু,
        যত্নে-পাট-করা লম্বা চুল,
           বড়ো বড়ো চোখ,
               শৌখিন মেজাজ।
           কর্নেট বাজানো তার শখ।
    মাঝে মাঝে সুর জেগে ওঠে
           এ গলির বীভৎস বাতাসে–

    কখনো গভীর রাতে,        
ভোরবেলা আধো অন্ধকারে,
    কখনো বৈকালে
        ঝিকিমিকি আলোয় ছায়ায়।
    হঠাৎ সন্ধ্যায়
সিন্ধু-বারোয়াঁয় লাগে তান,
        সমস্ত আকাশে বাজে
           অনাদি কালের বিরহবেদনা।
               তখনি মুহূর্তে ধরা পড়ে
                   এ গলিটা ঘোর মিছে,
            দুর্বিষহ, মাতালের প্রলাপের মতো।
                   হঠাৎ খবর পাই মনে
           আকবর বাদশার সঙ্গে
               হরিপদ কেরানির কোনো ভেদ নেই।
                   বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে
           ছেঁড়াছাতা রাজছত্র মিলে চলে গেছে
                          এক বৈকুণ্ঠের দিকে।

    এ গান যেখানে সত্য
অনন্ত গোধূলিলগ্নে
        সেইখানে
           বহি চলে ধলেশ্বরী;
        তীরে তমালের ঘন ছায়া;
               আঙিনাতে
       যে আছে অপেক্ষা ক’রে, তার
          পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

Poem divider

বোধ – জীবনানন্দ দাশ

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।

পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।

আমি থামি—
সেও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।

হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা

আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।

মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।

Poem divider

আট বছর আগের একদিন – জীবনানন্দ দাশ

শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;

বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল
কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম— অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
এই কথা বলেছিলো তারে

চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।

তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।

টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে।

রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।

ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।

অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার!

ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?

জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের–
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে— গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।

শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।

জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে

ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।

তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’

হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো
কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

Poem divider

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও – জীবনানন্দ দাশ

তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও―আমি এই বাংলার পারে
র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
দেখিব খয়েরী ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে―একবার―দুইবার―তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;
দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ―শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে
শঙ্খের মতো কাঁদে; সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে,

খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে―
‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে,
কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে―
নীরবে পা ধোয় জলে একবার―তারপর দূরে নির‍ুদ্দেশে
চ’লে যায় কুয়াশায়,―তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে
হারাব না তারে আমি―সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।

Poem divider

প্রিয় কবিতার এই পাঠককে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে এত দারুণ সব কবিতা শেয়ার করার জন্য। আশা করি তার পাঠক জীবনে তিনি আরো দারুণ সব কবিতা পড়ার সৌভাগ্য পাবেন। তার জন্য শুভকামনা।

আপনিও যদি নিজের প্রিয় কবিতাটি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। আমরা সেটা ভাগ করে নেব আরো অসংখ্য পাঠকের সাথে।

আমাদের অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গী হতে চোখ রাখুন আমাদের ফেসবুক পেইজে, নিয়মিত ভিজিট করুন লণ্ঠনে। যোগ দিন শিল্পের এক নতুন উৎসবে।

ছড়িয়ে দিন ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *