বৈশাখী প্রিয় কবিতা উৎসব – আহমেদ পাশা ফয়সালের সাথে

কবিতা প্রেমের রাজধানী। এই প্রেম শুধুমাত্র কপোত-কপোতীর প্রেম না। কবিতা সবার আগে মানুষকে নিজের প্রেমে মজতে শেখায়। কবিতা অসময়ে ছায়া দেয়, সুসময়ে ছায়া দিতে শেখায়। কবিতা মানুষের বুকের ভেতরের কথা বলে।

পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো। মাত্র একদিনের নোটিশে এই আয়োজন আমরা করতে চেয়েছিলাম। ভয়, শঙ্কা দুটোই ছিলো। কিন্তু আপনাদের উৎফুল্ল অংশগ্রহণ আমাদের শুধু সাহস যোগায়নি, দিয়েছে অনুপ্রেরণাও। আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আমাদের এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।

আজকে থাকছে আহমেদ পাশা ফয়সাল-এর প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আয়োজন। আশা করি তার প্রিয় কবিতাগুলো আপনাদেরও ছুঁয়ে যাবে।

বোধ – জীবনানন্দ দাশ

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।

পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।

আমি থামি—
সেও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?

জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।

হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্‌টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্‌টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;

আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা

আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।

মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!

এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্‌কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।

Poem divider

সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে – হুমায়ুন আজাদ

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।

আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।

Poem divider

লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক – ফরহাদ মজহার

গতকাল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে
তোমার আক্রমণ ছিল চোরাগুপ্তা
কা পু রু ষ
পশ্চাতদেশ থেকে পরিচালিত ছিল তোমার হামলা
কা পু রু ষ

গরগর গরগর গরগর করতে করতে
পেছন থেকে
ষাট মাইল বেগে

হ্যাঁ, ষাট মাইল বেগে এবং পেছন থেকে
পেছন থেকে এবং ষাট মাইল বেগে

আচমকা
তোমার নিষ্ঠুর ওজন-সর্বস্ব শরীর
আর খুনলিপু চাকা
দুমড়ে মুচড়ে পিষে দিয়েছে একগুচ্ছ তারুণ্য

পেছন থেকে এবং ষাট মাইল বেগে
ষাট মাইল বেগে এবং পেছন থেকে

তুমি
ট্রাক
কাপুরুষ বেঈমান ট্রাক।

মনে আছে
তোমাকে প্রথম যেদিন দেখি
আমি তোমার মিলিটারীমার্কা চেহারায়
ভীত হইনি একফোঁটা
তোমাকে ড্রাইভার স্টার্ট নেবার পর
তুমি কেঁপে উঠলে
থরথর থরথর থরথর থরথর….।

ভেবেছি এও এক ধরনের সংবেদনশীলতা
লোহা রাবার আর পেট্রোলের মিলমিশের মধ্যে
তুমিও একপ্রকার জীবন
কিন্তু গতকাল
তুমি যখন পিষে পিষে হত্যা করলে
তখন
হে থরথর থরথর থরথর থরথর করা
আমার প্রথম দেখা ট্রাক
তুমি একবার
একবারও তো
থর থর থর করে উঠলে না?

তোমার চাকার তলায়
জড়িয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জড়িয়ে
কিমকার মাংসের পিণ্ডের মতো লেপ্টে গিয়েছিল
তরতাজা শরীর
তুমি একফোঁটাও কাঁপোনি
আমি জানতাম তোমার ভারী রাবারের টায়ারের মধ্যে আছে
একপ্রকার স্পর্শকাতরতা
অথচ ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্তের উষ্ণতা তুমি টের পাওনি
আমি জানতাম
তোমার লৌহজাত শরীরের খনিজ ভঙ্গির মধ্যে আছে
একপ্রকার স্নায়বিক উদ্বেগ
অথচ অস্থি মজ্জা মাংসের ছত্রখান নিষ্পেষণে
তোমার উদ্বেগ বিচলিত হয়নি
তোমার হেডলাইটের চক্ষুর মধ্যে ছিল একপ্রকার
দৃষ্টিকাতর কমনীয়তা
অথচ তুমি একবারও কাতর হওনি
তোমার ইঞ্জিনে স্টিয়ারিংয়ে কারবুরেটরে
একপ্রকার স্পন্দন আছে যাকে আমি নির্মানবিক বলিনা
কিন্তু তবু
হে আমার থরথর থরথর থরথর করা
প্রথম দেখা ট্রাক
তুমি তোমার এইসকল ইন্দ্রিয়সমূহের বিরুদ্ধে
নির্মানবিক অভ্যুত্থান সম্পন্ন করে
একজন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের মতো
ঠাণ্ডা মাথায়
নির্বিকার হত্যায় মেতে উঠলে।

লাশে লাশে থেমে গিয়েছিল তোমার চাকা
তরতাজা তরুণ মাংসের ভারে থেমে গিয়েছিল তোমার স্টিয়ারিং
কিমাকার অস্থিমজ্জা রক্তের ফুটপাতের উপর
পিছলে গিয়েছিলে তুমি কয়েকবার

ষাট মাইল বেগে এবং পেছন থেকে
পেছন থেকে এবং ষাট মাইল বেগে!

দ্রুত তেড়ে আসা ট্রাক
তুমি
আবেগের বশবর্তী না হোক
অন্তত: যান্ত্রিক কোন ভুলে
নেহায়েত কোন কলকব্জাজনিত অসুবিধায়
একবারও
একবারও তো
থামলে না!

তবে কি তুমি আমার সেই প্রথম দেখা ট্রাক নও
যার ধাতব পৌরুষের মধ্যে আমি আবিষ্কার করতাম
মানুষের ইন্দ্রিয় আঙুল ও স্পর্শ?

দানবীয়তা ছিল তার গরগর ভাষার মধ্যে
কিন্তু তার স্বরযন্ত্রের মধ্যে আমি আবিষ্কার করতাম
একপ্রকার জিহবা ও ব্যাটারিচালিত আলজিভ
যার অতিকায় শরীরকে যর্থার্থ অর্থে কখনোই আমার
পাশবিক মনে হতো না
কারণ তার জন্ম মানুষের যুক্তিতে ও প্রজ্ঞায়
অধ্যবসায়ে ও নির্মাণশৈলিতে
অতএব জ্যামিতিক কৃৎকৌশলের মসৃণতা ছিল তার স্বভাবে
যেনবা বৃত্ত থেকে উৎপন্ন তার উর্দ্ধশ্বাস চতুষ্পদ পা
আয়তক্ষেত্র থেকে স্বাস্থ্য ও শরীর
বিভিন্ন প্রকার সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ বিপ্রতীপ কোণ
ও সোজা বাঁকা সরলরেখা থেকে উৎপন্ন স্বনির্ভর যৌবন

তুমি সুন্দর
মানবীয় প্রতিটি নির্মাণের প্রতি শ্রদ্ধায় আমি বলেছিলাম
তুমি সুন্দর

তোমার পিঠে সমস্ত বাংলাদেশ তুলে নিয়ে
দ্রুত টগবগিয়ে সুন্দর লালচে একটি গ্রহে যাবার
পরিকল্পনা ছিল আমার

কিন্তু তুমি
ষাট মাইল বেগে এবং পেছন থেকে
পেছন থেকে এবং ষাট মাইল বেগে

হে অদ্ভুত অচেনা বিদেশী থেকে আমদানী হয়ে আসা ট্রাক
আমার স্মৃতি থেকে
অন্তর্হিত হলে।

ট্রাক তুমি কার?
ট্রাক তুমি কার এবং কে?
ট্রাক তুমি কাদের এবং তুমি পেছন থেকে কেন?

অতীতের সব যুদ্ধই তো ছিল মুখোমুখি
আক্রমণ পরিচালিত হয়েছে সামনাসামনি
ট্রাক তুমি কোত্থেকে এবং এতো আকস্মিক কেন?
তবে কি মানুষের মিছিল তোমাকে অতিক্রম করে আসতে পেরেছে?
তোমাকে পেছনে ফেলে সত্যি সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে মিছিল?
সত্যিসত্যিই?
ট্রাক?
ইতিহাসের ময়লা বহনকারী
শেষতম পরিবহন সংস্থার ট্রাক?

তাহলে কি এবারকার যুদ্ধ অন্যরকম?
তাহলে কি এবারকার যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ?
ইতিহাস কি তাহলে এবার অন্যভাবে সশস্ত্র?
অতীতে তোমার আগে
মিছিলের মুখোমুখী হতে না পেরে উল্লম্ফন দিয়েছে অনেকে
বিক্ষুদ্ধ মানুষের ভয়ে মিছিলের মাথার ওপর দিয়ে
হাইজাম্প ….. সার্কাস
সেইসব নানানকিসিমের সার্কাসওয়ালাদের হরেক রকম সার্কাসকর্ম
খামোশ করে দিয়েছে এইসব মিছিল
গা বাঁচিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবার নজির আছে বহু
মিছিলের লক্ষ লক্ষ হাত সাঁড়াশীর মতো
তাদের নাম নিশানা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে
উজীর নাজীর রাজা-বাদশাহ ছোট জেনারেল বড় জেনারেল
ফিল্ডমার্শাল
এসেছে আর গিয়েছে
এই মিছিল অতিক্রম করার তৌফিক তাদের হয়নি

হে সামরিক পোশাক পরিহিত
শাহনশার মতো ট্রাক
এই মিছিল
তোমার মতো বহুত শাহানশাকে উলঙ্গ করে ছেড়েছে
তারপর প্রস্রাব করতে করতে
প্রস্রাব করতে করতে
প্রস্রাব করতে করতে…
সামরিক আইন প্রশাসকের দফতরগুলো
পরিণত হয়েছে মিউনিসিপালিটির
প্রস্রাবখানায়।

না আমি শোকগ্রস্ত নই
আমি শোকগ্রস্ত নই কারণ মিছিল অন্যরকম মোড় নিচ্ছে
আমি শোকমিছিলে যাব না কারণ এ মিছিল শোকমিছিল নয়
আমি কালব্যাজ পরব না কারণ সময় তার বুকপকেটে
দীর্ঘ লাল ব্যাজ ধারণ করেছে

এখন সময় অন্যরকম
এখন সময় অন্যভাবে সশস্ত্র

ষাট মাইল বেগে এবং পেছন থেকে
পেছন থেকে এবং ষাট মাইল বেগে!

তুমি যতোই চোরাগুপ্তা হামলা চালাও
মিছিল নিরন্তর এখন সামনের দিকে

মিছিল-
মিছিল নিরন্তর সামনের দিকে
সব মিছিল এখন সামনের দিকে
অতএব হে ট্রাক
আমাদের সব মিছিল সোজা সিধা সামনের দিকে
ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে
দুনিয়ার তাবৎ সামরিক ঘাঁটিগুলোর দিকে এই
লেফটেনান্ট জেনারেল ট্রাক
প্রেসিডেন্ট ট্রাক
তোমার সঙ্গে
শেষবার সামনাসামনি
ফয়সালা হবে।

Poem divider

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য

যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি
যে ভাই এখনও নির্লজ্জ স্বাভাবিক হয়ে আছে
আমি তাকে ঘৃণা করি –
যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরাণী
প্রকাশ্যপথে এই হত্যার প্রতিশোধ চায় না
আমি তাকে ঘৃণা করি —

আটজন মৃতদেহ
চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
আমি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাচ্ছি
আট জোড়া খোলা চোখ আমাকে ঘুমের মধ্যে দেখে
আমি চিৎকার করে উঠি
আমাকে তারা ডাকছে অবেলায় উদ্যানে সকল সময়
আমি উন্মাদ হয়ে যাবো
আত্মহ্ত্যা করবো
যা ইচ্ছা চায় তাই করবো

কবিতা এখনই লেখার সময়
ইস্তেহারে দেয়ালে স্টেনসিলে
নিজের রক্ত অশ্রু হাড় দিয়ে কোলাজ পদ্ধতিতে
এখনই কবিতা লেখা যায়
তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখে
সন্ত্রাসের মুখোমুখি – ভ্যানের হেডলাইটের ঝলসানো আলোয়
স্থির দৃষ্টি রেখে
এখনই কবিতা ছুঁড়ে দেওয়া যায়
৩৮ ও আরো যা যা আছে হত্যাকারীর কাছে
সব অস্বীকার করে এখনই কবিতা পড়া যায়

লক-আপের পাথর হিম কক্ষে
ময়না তদন্তের হ্যাজাক আলোক কাঁপিয়ে দিয়ে
হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে
মিথ্যা অশিক্ষার বিদ্যায়তনে
শোষণ ও ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে
সামরিক-অসামরিক কর্তৃপক্ষের বুকে
কবিতার প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হোক
বাংলাদেশের কবিরাও লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার
স্টেনগানের গুলিতে সেলাই হয়ে যাবার জন্য প্রস্তত থাকুক
তবু. কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে
ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না

আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব
বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকি না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেব ইচ্ছেমতো
ডেকে নেবো টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মতো দীঘি
ভালোবাসা — যার থেকে আলোকবর্ষ দূরে জন্মাবধি অচ্ছুৎ হয়ে আছি —
তাকেও ডেকে নেব কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন

হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে রাত্রিদিন ইনটারোগেশন
মানি না
নখের মধ্যে সূঁচ বরফের চাঙড়ে শুইয়ে রাখা
মানি না
পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে যতক্ষণ রক্ত ঝরে নাক দিয়ে
মানি না
ঠোঁটের ওপরে বুট জ্বলন্ত শলাকায় সারা গায় ক্ষত
মানি না
ধারালো চাবুক দিয়ে খণ্ড খণ্ড রক্তাক্ত পিঠে সহসা আ্যালকোহল
মানি না
নগ্নদেহে ইলেকট্রিক শক কুৎসিত বিকৃত যৌন অত্যাচার
মানি না
পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি
মানি না
কবিতা কোন বাধাকে স্বীকার করে না
কবিতা সশস্ত্র কবিতা স্বাধীন কবিতা নির্ভীক
চেয়ে দেখো মায়কোভস্কি হিকমেত নেরুদা আরাগঁ এলুয়ার
তোমাদের কবিতাকে আমরা হেরে যেতে দিইনি
বরং সারাটা দেশ জুড়ে নতুন একটা মহাকাব্য লেখবার চেষ্টা চলছে
গেরিলা ছন্দে রচিত হতে চলেছে সকল অলংকার

গর্জে উঠুক দল মাদল
প্রবাল দ্বীপের মত আদিবাসী গ্রাম
রক্তে লাল নীলক্ষেত
শঙ্খচূড়ের বিষ-ফেনা মুখে আহত তিতাস
বিষাক্ত মৃত্যুসিক্ত তৃষ্ণায় কুচিলা
টংকারে সূর্য অন্ধ উৎক্ষিপ্ত গাণ্ডীবের ছিলা
তীক্ষ্ম তীর হিংস্রতম ফলা —
ভাল্লা তোমার টাঙ্গি পাশ
ঝলকে ঝলকে বল্লম চর-দখলের সড়কি বর্শা
মাদলের তালে তালে রক্তচক্ষু ট্রাইবাল টোটেম
বন্দুক কুরকি দা ও রাশি রাশি সাহস
এত সাহস যে আর ভয় করে না
আরো আছে ক্রেন, দাঁতালো বুলডজার বনভয়ের মিছিল
চলমান ডাইনামো টারবাইন লেদ ও ইনজিন
ধ্বস-নামা কয়লার মিথেন অন্ধকারে কঠিন হীরার মতো চোখ
আশ্চর্য ইস্পাতের হাতুড়ি
ডক জুটমিল ফার্ণেসের আকাশে উত্তোলিত সহস্র হাতে
না ভয় করে না
ভয়ের ফ্যাকাশে মুখ কেমন অচেনা লাগে
যখন জানি মৃত্যু ভালোবাসা ছাড়া কিছু নয়।
আমাকে হ্ত্যা করলে
বাংলার সব কটি মাটির প্রদীপে শিখা হয়ে ছড়িয়ে যাবো
আমার বিনাশ নেই
বছর বছর মাটির মধ্য হতে সবুজ আশ্বাস হয়ে ফিরে আসব
আমার বিনাশ নেই –
সুখে থাকব, দুঃখে থাকব সন্তান-জন্মে সৎকারে
বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন
মানুষ যতদিন থাকবে ততদিন

যে মৃত্যু রাত্রির শীতে জ্বলন্ত বুদ্বুদ হয়ে উঠে যায়
সেই দিন সেই যুদ্ধ সেই মৃত্যু আনো
সেভেনথ ফ্লিট-কে রুখে দিক সপ্তডিঙ্গা মধুকর
শিঙা ও শঙ্খে যুদ্ধারম্ভ ঘোষিত হয়ে যাক
রক্তের গন্ধ নিয়ে বাতাস যখন মাতাল
জ্বলে উঠুক কবিতা বিস্ফোরক বারুদের মাটি —
আলপনা গ্রাম নৌকা নগর মন্দির
যখন তরাই থেকে সুন্দরবনের সীমা
সারা রাত্রির কান্নার পর শুষ্ক দাহ্য হয়ে আছে
যখন জন্মভূমির মাটি ও বধ্যভূমির কাদা এক হয়ে গেছে

তখন আর দ্বিধা কেন
সংশয় কিসের
ত্রাস কী
আটজন স্পর্শ করেছে
গ্রহণের অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছে কোথায় কখন প্রহরা
তাদের কণ্ঠে অযুত তারকাপুঞ্জ ছায়াপথ সমুদ্র
গ্রহ থেকে গ্রহে ভেসে বেড়াবার উত্তরাধিকার —
কবিতার জ্বলন্ত মশাল
কবিতার মলোটভ ককটেল
কবিতার টলউইন অগ্নিশিখা
এই আগুনের আকাঙ্খাতে আছড়ে পড়ুক।

Poem divider

ঊনিশশো চৌত্রিশের – জীবনানন্দ দাশ

একটা মোটরকার
খটকা নিয়ে আসে।

মোটরকার সব-সময়েই একটা অন্ধকার জিনিস,
যদিও দিনের রৌদ্র-আলোর পথে
রাতের সুদীপ্ত গ্যাসের ভিতর
আলোর সন্তানদের মধ্যে
তার নাম সবচেয়ে প্রথম।

একটা অন্ধকার জিনিস :
পরিষ্কার ভোরের বেলা
দেশের মটরশুঁটি-কড়াইয়ের সবুজ ক্ষেতে-মাঠে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি
লাল সুরকির রাস্তার ভিতর দিয়ে
হিজলগাছ দুটোর নিচে দিয়ে
উনিশশো চৌত্রিশের মডেল একটা মোটরকার
ঝকমক করছে, ঝড় উড়িয়ে ছুটেছে;
পথ ঘাট ক্ষেত শিশির সরে যেতে থাকে,
ভোরের আলো প্রতিকূল যুক্তির বিরুদ্ধে কোণের বধূর মতো
সহসা অগোচর
মাঠ নদী যেন নিশ্চেষ্ট,
সহসা যেন প্রতীজ্ঞা হারিয়ে ফেলে,
এই মোটর অগ্রদূত,
সে ছুটে চলেছে
যেই পথে সকলের যাওয়া উচিত;
একটা মোটরকারের পথ
সব সময়েই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।
স্ট্যান্ডে
শহরের বিরাট ময়দানের পুবে পশ্চিমে-ফুটপাথের পাশে
মোটারকার;
নিঃশব্দ।
মাথায় হুড
ভিতরের বুরুশ-করা গভীর গদিগুলো
পালিশ স্টিয়ারিং-হুইল হেডলাইট;
কী নিয়ে স্থির?
কলকাতার ময়দানের একটা গাছ অন্য কিছু নিয়ে স্থির,
আমি অন্যকিছু নিয়ে স্থির;
মোটরের স্থিরতা একটা অন্ধকার জিনিস

একটা অন্ধকার জিনিস :
রাতের অন্ধকারে হাজার-হাজার কার হু-হু করে ছুটছে
প্যারিসে-নিউইয়র্কে-লন্ডনে-বার্লিনে-ভিয়েনায়-কলকাতায়
সমুদ্রের এপার ওপার ছুঁয়ে
অসংখ্য তারের মতো,
রাতের উল্কার মতো,
মানুষ-মানুষীর অবিরাম সংকল্প আয়োজনের অজস্র আলেয়ার মতো
তারাও চলেছে;
কোথায় চলেছে, তা আমি জানি না।

একটা মোটরকারের পথ- মোটরকার
সবসময়ই আমার কাছে খটকার মতো মনে হয়েছে,
অন্ধকারের মতো।

আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা
অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না :
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

Poem divider

জেলখানার চিঠি – নাজিম হিকমত

অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়


প্রিয়তমা আমার
তেমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছ ;
মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।

তুমি লিখেছ ;
যদি ওরা তেমাকে ফাঁসী দেয়
তোমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।

তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধু আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড় জোর এক বছর।

মৃত্যু…
দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাসীর দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।

অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব আমার বন্ধুদের, তোমাকে দেখব
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।


বধু আমার
তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে ।

ও নিয়ে ভেবনা
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে।

বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।

গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।

আমি তোমাকে চাই ;তোমার মত রমনীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু,আমার প্রিয়তমার মত…..।।।

আমি জানি, দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।


নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত, আমার প্রিয়তমা
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে।

মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস, তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।

রাত্রির অন্ধকারে,গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।

আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।


রাত এখন ন’টা
ঘন্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলের দরোজা তালা বন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশি দিন কাঁটল
আটটা বছর।

বেঁচে থাকায় অনেক আশা,প্রিয়তমা
তোমাকে ভালবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর কী আশায় রঙ্গীন তোমার স্মৃতি….।
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আমি আর শুনতে চাই না গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইব।

আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের ওপর এলানো
আমরা আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে !


যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।


কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধুসর চোখে তুমি আছো আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে
মাটির বুক ফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আদ্র ওষ্ঠোধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

আশাভঙ্গে অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে।
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাই নি?

Poem divider

স্নান – জয় গোস্বামী

সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার –
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে …

জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব’লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।

আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?

শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক’রে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ’রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোস্নার ধারণা দেব ব’লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।

দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত –
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার…
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক’রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।

Poem divider

প্রিয় কবিতার এই পাঠককে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে এত দারুণ সব কবিতা শেয়ার করার জন্য। আশা করি তার পাঠক জীবনে তিনি আরো দারুণ সব কবিতা পড়ার সৌভাগ্য পাবেন। তার জন্য শুভকামনা।

আপনিও যদি নিজের প্রিয় কবিতাটি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। আমরা সেটা ভাগ করে নেব আরো অসংখ্য পাঠকের সাথে।

আমাদের অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গী হতে চোখ রাখুন আমাদের ফেসবুক পেইজে, নিয়মিত ভিজিট করুন লণ্ঠনে। যোগ দিন শিল্পের এক নতুন উৎসবে।

ছড়িয়ে দিন ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *