"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
বৈশাখী প্রিয় কবিতা উৎসব – আহমেদ জুয়েলের সাথে

কবিতা প্রেমের রাজধানী। এই প্রেম শুধুমাত্র কপোত-কপোতীর প্রেম না। কবিতা সবার আগে মানুষকে নিজের প্রেমে মজতে শেখায়। কবিতা অসময়ে ছায়া দেয়, সুসময়ে ছায়া দিতে শেখায়। কবিতা মানুষের বুকের ভেতরের কথা বলে।
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো। মাত্র একদিনের নোটিশে এই আয়োজন আমরা করতে চেয়েছিলাম। ভয়, শঙ্কা দুটোই ছিলো। কিন্তু আপনাদের উৎফুল্ল অংশগ্রহণ আমাদের শুধু সাহস যোগায়নি, দিয়েছে অনুপ্রেরণাও। আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আমাদের এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।
আজকে থাকছে আহমেদ জুয়েল-এর প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আয়োজন। আশা করি তার প্রিয় কবিতাগুলো আপনাদেরও ছুঁয়ে যাবে।
এসো, হে অশুভ – হুমায়ুন আজাদ
চারদিকে শুনছি তোমার রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর।
মেঘে মেঘে ঝিলিক দিচ্ছে তোমার দীর্ঘ শরীরের রূপরেখা।
ঘন কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে পুব থেকে পশ্চিমে,
উত্তর থেকে দক্ষিণে, মেঘ থেকে মাটিতে।
তোমার ঢেউ খেলানো মস্তক থেকে পল্লীর পথপ্রান্তে খ’সে পড়ছে
দু-চারটি ঝলমলে বিস্ময়কর চুল,
তোমার হাত থেকে খসে পড়া অশুভ রুমালে ঢেকে যাচ্ছে
শহরের পর শহর, সমুদ্র আর বিমানবন্দর।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা স্থলপথ, তুমি স্থলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা জলপথ, তুমি জলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সমস্ত আকাশ, তুমি আকাশপথে এসো।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব গৃহ, তুমি সব গৃহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব প্রাঙ্গণ, তুমি সব প্রাঙ্গণে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব মন্দির, তুমি সব মন্দিরে এসো।
হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি চৈত্রের কৃষ্ণচুড়া হয়ে এসো
হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে
হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়।
এখানে কি কেউ জনককে হত্যা করে জননীর সাথে
লিপ্ত অজাচারে? বাঙলা কি পৃথিবীর নতুন করিন্থ?
হে অশুভ, দিন হয়ে এসো তুমি রাত্রি হয়ে এসো
হে অশুভ, সূর্য হয়ে ওঠো পুবে চাঁদ হয়ে ওঠো পশ্চিমে
হে অশুভ, শস্য হয়ে ফুলে ওঠো প্রতিটি পাকা ধান্যবীজে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা,
তুমি সমস্ত দিক আর দিগন্ত থেকে এসো।
পাড়ার গুণ্ডা হয়ে এসো তুমি পাড়ায় পাড়ায়
ধর্ষণকারী হয়ে এসো তুমি প্রতিটি রাস্তায়
ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকো বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের গলিতে
দশটা হেডলাইট জ্বালিয়ে এসো শহরের প্রধান সড়কে
এসো তুমি সাইলেন্সরহীন মোটর সাইকেলে
এসো তুমি দূরপাল্লার লাকশারি কোচে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা, সর্বব্যাপী
হয়ে তুমি এসো।
এসো বুট পায়ে ইউনিফর্ম প’রে
এসো পতাকাখচিত মার্সিডিস চ’ড়ে
এসো বাসে ঝুলে রিকশায় চেপে
এসো ব্যাংকের কাউন্টারে ঝলমলে নোটের বাণ্ডিল হয়ে
এসো গ্রন্থাগারে সারিসারি গ্রন্থ হয়ে
আমার ছাত্র হয়ে এসো তুমি ঘণ্টায় ঘণ্টায়
অধ্যাপক হয়ে এসো শ্রেণীতে শ্রেণীতে
এসো সচিব ও যুগ্ম সচিব হয়ে
এসো মন্ত্রী হয়ে
ব্যবস্থাপক হয়ে এসো সংস্থায় সংস্থায়।
হে অশুভ, তুমি প্রেমিকপ্রেমিকার প্রেমালাপে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রত্যেকের চুম্বনে আলিঙ্গনে এসো
হে অশুভ, প্রতিটি শয্যায় তুমি পুলক হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে
এসো হে অশুভ, তুমি আমাদের প্রত্যকের প্রার্থনায় এসো
হে অশুভ, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল হয়ে তুমি এসো।

সাবধান – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমি সেই মানুষ, আমাকে চেয়ে দ্যাখো
আমি ফিরে এসেছি
আমার কপালে রক্ত;
বাষ্প-জমা গলায় বাস-ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে
ফিরে এলাম-
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ
আমার নিশ্বাস-।
রাস্তায় একটা বাচ্চা ছেলে বমি করলো
আমি ওর মৃত্যুর জন্য দায়ী-
পিছনের দরজায় বস্তাভর্তি টাকা ঘুষ নিচ্ছিল যে লোকটা
আমি তার হত্যার জন্য দায়ী-
আমি পুলিশের বোকামি দেখে প্রকাশ্যে হাসাহাসি করবো
আমি নেহেরুর উইল সম্পর্কে শুনবো ট্রামের লোকের ইয়ার্কি
কম্যুনিষ্টদের শ্লোগানের শবযাত্রা দেখে আমার দয়াও হবে না;
আমি ভয়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে জেগে উঠবো মমতায়
আমি মেয়েটির কাছে গিয়ে নিঃশব্দে মুখ চুম্বন করবো
সশরীরে বিছানায় শুয়ে দু’জনে কাঁদবো নানা ধরনে
পরদিন ঠিকঠাক বেঁচে উঠতে হবে, এই জেনে।
আমার গলা পরিস্কার, আমি স্পষ্ট করে কথা বলবো
সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে শুদ্ধভাবে
আমি
আজ উচ্চারণ করবো সেই পরম মন্ত্র
আমাকে বাঁচতে না দিলে এ পৃথিবীও আর বাঁচবে না।

বারবারা বিডলারকে – আসাদ চৌধুরী
বারবারা
ভিয়েতনামের উপর তোমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-
তোমার হৃদয়ের সুবাতাস
আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল
প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলোরজন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়
আমি তোমার ওই একটি লেখাই পড়েছি
আশীর্বাদ করেছিলাম, তোমার সোনার দোয়াত কলম হোক।
আমার বড়ো জানতে ইচ্ছে করে বারবারা, তুমি এখন কেমন আছ ?
নিশ্চয়ই তুমি ডেট করতে শিখে গেছ।
গাউনের রঙ আর হ্যাট নিয়ে কি চায়ের টেবিলে মার সঙ্গে ঝগড়া হয়?
অনভ্যস্ত ব্রেসিয়ারের নিচে তোমার হৃদয়কে কি চিরদিন ঢেকে দিলে।
আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে বারবারা।
তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-
বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো
ওটা একটা জল্লাদের ছবি
পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠাণ্ডা মাথায় সে হ্ত্যা করেছে
মানুষের কষ্টার্জিত সভ্যতাকে সেগলা টিপে হত্যা করেছে
অদ্ভুত জাদুকরকে দেখ
বিংশ শতাব্দীকে সে কৌশলে টেনে হিঁচড়ে মধ্যযুগে নিয়ে যায়।
দেশলাইয়ের বাক্সর মতো সহজে ভাঙে
গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,
মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি
সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতোয়
থেতলে দেয়।
২
টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা ?
গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকেদেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে
আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল-
সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিয়ো বাংলাদেশে
তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে
তিনি শিউরে উঠবেন।
অভিধান থেকে নয়
আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী ?
জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো-
সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য
মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিয়োনা-
নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।
বারবারা এসো,
রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই
বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি
অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই
জল্লাদের শাণিত অস্ত্র
সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,
দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে
এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।

প্রত্যাবর্তন – হেলাল হাফিজ
প্রত্যাবর্তনের পথে
কিছু কিছু ‘কস্ট্লি’ অতীত থেকে যায়।
কেউ ফেরে, কেউ কেউ কখনো ফেরে না।
কেউ ফিরে এসে কিছু পায়,
মৌলিক প্রেমিক আর কবি হলে অধিক হারায়।
তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।
প্রত্যাবর্তনের প্তহে
পিতার প্রস্থান থেকে,
থাকে প্রণয়ের প্রাথমিক স্কুল,
মাতার মলিন স্মৃতি ফোটায় ধ্রুপদী হুল,
যুদ্ধোত্তর মানুষের মূল্যবোধ পালটায় তুমুল,
নেতা ভুল,
বাগানে নষ্ট ফুল,
অকথিত কথার বকুল
বছর পাঁচেক বেশ এ্যানাটমিক ক্লাশ করে বুকে।
প্রত্যাবর্তনের পথে
ভেতরে ক্ষরণ থাকে লাল-নীল প্রতিনিয়তই,
তাহকে প্রেসক্লাব–কার্ডরুম, রঙিন জামার শোক,
থাকে সুখী স্টেডিয়াম,
উদ্গ্রীব হয়ে থাকে অভিজাত বিপনী বিতান,
বাথরুম, নগরীর নিয়ন্ত্রিত আঁধারের বার,
থাকে অসুস্থ সচ্ছলতা, দীর্ঘ রজনী
থাকে কোমল কিশোর,
প্রত্যাবর্তনের পথে দুঃসময়ে এইভাবে
মূলত বিদ্রোহ করে বেহালার সুর।
তারপর ফেরে, তবু ফেরে, কেউ তো ফেরেই,
আর জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়,
ভালোবাসা যাকে খায় এইভাবে সবটুকু খায়।

অভিশাপ দিচ্ছি – শামসুর রাহমান
না, আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে,
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিলো আমাদেরই আপনজনের লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত,
যারা গণহত্যা
করেছে শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে,
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক
পশু সেই সব পশুদের।
ফায়ারিং স্কোয়াডে ওদের
সারিবদ্ধ দাঁড়
করিয়ে নিমেষে ঝাঁ ঝাঁ বুলেটের বৃষ্টি
ঝরালেই সব চুকে-বুকে যাবে তা আমি মানি না।
হত্যাকে উৎসব ভেবে যারা পার্কে মাঠে
ক্যাম্পাসে বাজারে
বিষাক্ত গ্যাসের মতো মৃত্যুর বীভৎস গন্ধ দিয়েছে ছড়িয়ে,
আমি তো তাদের জন্যে অমন সহজ মৃত্যু করি না কামনা।
আমাকে করেছে বাধ্য যারা
আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত
সিঁড়ি ভেঙে যেতে
ভাসতে নদীতে আর বনবাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে,
অভিশাপ দিচ্ছি আজ সেই খানে-দজ্জালদের।
অভিশাপ দিচ্ছি ওরা চিরদিন বিশীর্ণ গলায়
নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিতে নাছোড় মৃতদেহ,
অভিশাপ দিচ্ছি
প্রত্যহ দিনের শেষে ওরা
হাঁটু মুড়ে এক টুকরো শুকনো রুটি চাইবে ব্যাকুল,
কিন্তু রুটি প্রসারিত থাবা থেকে রইবে
দশ হাত দূরে সর্বদাই।
অভিশাপ দিচ্ছি
ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার
কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, যে রক্ত বাংলায়
বইয়ে দিয়েছে ওরা হিংস্র
জোয়ারের মতো
অভিশাপ দিচ্ছি
আকণ্ঠ বিষ্ঠায় ডুবে ওরা অধীর চাইবে ত্রাণ
অথচ ওদের দিকে কেউ
দেবে না কখনও ছুড়ে একখণ্ড দড়ি।
অভিশাপ দিচ্ছি
স্নেহের কাঙাল হয়ে ওরা
ঘুরবে ক্ষ্যাপার মতো এপাড়া ওপাড়া,
নিজেরই সন্তান
প্রখর ফিরিয়ে নেবে মুখ, পারবে না
চিনতে কখনও;
অভিশাপ দিচ্ছি এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে, বিশ্রামের
কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে
দ্বারে দ্বারে ঘুরবে ওরা প্রেতায়িত
সেই সব মুখের ওপর
দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে পৃথিবীর প্রতিটি কপাট।
অভিশাপ দিচ্ছি।
অভিশাপ দিচ্ছি,
অভিশাপ দিচ্ছি…

অসমাপ্ত কবিতা – নির্মলেন্দু গুণ
মাননীয় সভাপতি। সভাপতি কে? কে সভাপতি?
ক্ষমা করবেন সভাপতি সাহেব,
আপনাকে আমি সভাপতি মানি না।
তবে কি রবীন্দ্রনাথ? সুভাষচন্দ্র বসু? হিটলার?
মাও সে তুং? না, কেউ না, আমি কাউকে মানি না,
আমি নিজে সভাপতি এই মহতী সভার।
মাউথপিস আমার হাতে এখন, আমি যা বলবো,
আপনারা তাই শুনবেন।
উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আমার সংগ্রামী বোনেরা,
(একজন অবশ্য আমার প্রেমিকা এখানে আছেন)
আমি আজ আপনাদের কাছে কিছু বলতে চাই।
আপনারা জানেন, আমি কবি,
রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়ার, এলিয়েটের মতোই
আমিও কবিতা লিখি এবং মূলত কবি।
কবিতা আমার নেশা, পেশা ও প্রতিশোধ গ্রহণের
হিরন্ময় হাতিয়ার! আমি কবি, কবি এবং কবিই।
কিন্তু আমি আর কবিতা লিখবো না ।
পল্টনের ভরা সমাবেশে আমি ঘোষণা করছি,
আমি আর কবিতা লিখবো না।
তবে কি রাজনীতি করবো? কান্ট্রাক্টারী?
পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক?
পত্রিকার সাব-এডিটর?
নীলক্ষেত কলাভবনের খাতায় হাজিরা?
বেশ্যার দালাল?
ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে তেল-নুন-ডালের দোকান?
রাজমিস্ত্রি? মোটর ড্রাইভিং? স্মাগলিং?
আন্ডারডেভেলপমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা?
নাকি সবাইকে ব্যঙ্গ করে, বিনয়ের সব চিহ্ন-সূত্র
ছিঁড়ে-খুঁড়ে প্রতিণ্ঠিত বুড়ো-বদ-কবিদের
চোখ-নাকে-মুখে কিংস্টর্কের কড়া ধোঁয়া ছুঁড়ে দেব?
অর্থাৎ অপমান করবো বৃদ্ধদের?
আপনারা কেউ বেশ্যাপাড়ায় ভুলেও যাবেন না,
এরকম প্রতিশ্রুতি দিলে বেশ্যার দালাল হতে পারি,
রসোন্মত্ত যৌবন অবধি-, একা-একা।
আমার বক্তব্য স্পট, আমার বিপক্ষে গেলেই
তথাকথিত রাজনীতিবিদ, গাড়ল বুদ্ধিজীবি,
অশিক্ষিত বিজ্ঞানী, দশতলা বাড়িওয়ালা ধনী-ব্যবসায়ী,
সাহিত্য-পত্রিকার জঘন্য সম্পাদক, অতিরিক্ত জনসমাবেশ
আমি ফুঁ দিয়ে তুলোর মতো উড়িয়ে দেবো।
আপনারা আমার সঙ্গে নদী যেমন জলের সঙ্গে
সহযোগিতা করে, তেমনি সহযোগিতা করবেন,
অন্যথায় আমি আমার ঘিয়া পাঞ্জাবির গভীর পকেটে
আমার প্রেমিকা এবং ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ ছাড়া
অনায়েসে পল্টনের ভরাট ময়দান তুলে নেবো।
ভাইসব, চেয়ে দেখুন, বাঙলার ভাগ্যাকাশে
আজ দুর্যোগের ঘনঘটা, সুনন্দার চোখে জল,
একজন প্রেমিকার খোজে আবুল হাসান
কী নিঃসঙ্গ ব্যাথায় কাঁপে রাত্রে, ভাঙে সূর্য,
ইপিআরটিসি’র বাস, লেখক সংঘের জানালা,
প্রেসট্রাস্টের সিঁড়ি, রাজীয়ার বাল্যকালীন প্রেম।
আপনারা কিছুই বোঝেন না, শুধু বিকেল তিনটা এলেই
পল্টনের মাঠে জমায়েত, হাততালি, জিন্দাবাদ,
রক্ত চাই ধ্বনি দিয়ে একুশের জঘন্য সংকলন,
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিনে নেন।
আমি শেষবারের মত বলছি, আপনারা যার-যার ঘরে,
পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে- সিঁদুরে ফিরে যান।
আমি এখন অপ্রকৃতিস্থ-,
পূর্ব বাঙলার অন্যতম ভীষণ মাতাল বক্তা একজন,
ফুঁ দিয়ে নেভাবো আগুন, উন্মাদ শহর,
আপনাদের অশ্লীল-গ্রাম্য-অসভ্য সমাবেশে,
লালসালু ঘেরা স্টেজ, মাউথ অর্গান, ডিআইটি,
গোল স্টেডিয়াম, এমসিসি’র খেলা,
ফল অফ দি রোমান এ্যাম্পায়ারের নগ্ন পোষ্টার।
এখন আমার হাতে কার্যরত নীল মাইক্রোফোন
উত্তেজিত এবং উন্মাদ।
শ্রদ্ধেয় সমাবেশ, আমি আমার সাংকেতিক
ভয়াবহ সান্ধ্য আইনের সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
মাধবীর সারা মাঠ খালি করে দেবেন।
আমি বড় ইনসিকিওরড, যুবতী মাধবী নিয়ে
ফাঁকা পথে ফিরে যেতে চাই ঘরে,
ব্যক্তিগত গ্রামে, কাশবনে।
আমি আপনাদের নির্বাচিত নেতা।
আমার সঙ্গে অনেক টাকা, জিন্নাহর কোটি কোটি
মাথা; আমি গণভোটে নির্বাচিত বিনয় বিশ্বাস,
রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, অথচ আমার কোনো
সিকিউরিটি নেই, একজন বডিগার্ড নেই,
সশস্ত্র হামলায় যদি টাকা কেড়ে নেয় কেউ
আমি কী করে হিসেব দেবো জনতাকে?
স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধি হলে কন্যার কাঁকন যাবে খোয়া,
আপনার আমার সকলের ক্ষতি হবে,
সোনার হাতে সোনার কাঁকন আর উঠবে না।
আপনারা ভাবেন, আমি খুব সেখেই আছি
কিন্তু বিশ্বেস করুন, হে পল্টন,
মাঘী পূর্ণিমার রাত থেকে ফাল্গুনের পয়লা অবধি
কী ভীষণ দুর্বিষহ আগুন জ্বলছে আমার দুখের দাড়িতে,
উষ্কখুক চুলে, মেরুদণ্ডের হাড়ে, নয়টি আঙুলে,
কোমরে, তালুতে, পাজামার গিঁটে, চোখের সকেটে।
দেখেছি তো কাম্যবস্তু স্বাধীনতা, প্রেমিকা ও গ্ণভোট
হাতে পেয়ে গেল নির্জন হীরার আগুনে
পুলিশের জীপ আর টায়ারের মতো পুড়ে-পুড়ে যাই,
অমর্যাদা করি তাকে যাকে চেয়ে ভেঙেছি প্রসাদ,
নদী, রাজমিস্ত্রী এবং গোলাপ।
আমি স্বাধীনতা পেয়ে গেলে পরাধীন হতে ভালোবাসি।
প্রেম এসে যাযাবর কন্ঠে চুমু খেলে মনে হয় বিরহের
স্মৃতিচারণের মতো সুখ কিছুই নেই।
বাক-স্বাধীনতা পেলে আমি শুধু প্রেম, রমণী, যৌনতা
ও জীবনের অশ্লীলতার কথা বলি।
আমি কিছুতেই বুঝিনা, আপনারা তবু কোন বিশ্বাসে
বাঙলার মানুষের ভবিষ্যৎ আমার স্কন্ধ চাপিয়ে দিলেন।
আপনারা কী চান?
ডাল-ভাত-নুন?
ঘর-জমি-বউ?
রূপ-রস-ফুল?
স্বাধীনতা?
রেফ্রিজারেটর?
ব্যাংক-বীমা-জুয়া?
স্বায়ত্তশাসন?
সমাজতন্ত্র?
আমি কিছুই পারি না দিতে,আমি শুধু কবিতার
অনেক স্তবক, অবাস্তব অন্ন বস্ত্র বীমাহীন
জীবনের ফুল এনে দিতে পারি সকলের হাতে।
আমি স্বাভাবিক সুস্থ সৌভাগ্যের মুখে থুথু দিয়ে
অস্বভাবিক অসুস্থ শ্রীমতী জীবন বুকে নিয়ে
কী করে কাটাতে হয় অরণ্যের ঝড়ের রাত্রিকে
তার শিক্ষা দিতে পারি। আমি রিজার্ভ ব্যাংকের
সবগুলো টাকা আপনাদের দিয়ে দিতে পারি,
কিন্তু আপনারাই বলুন অর্থ কি বিনিময়ের মাধ্যম?
জীবন কিংবা মৃত্যুর? প্রেম কিংবা যৌবনের?
অসম্ভব, অর্থ শুধু অনর্থের বিনিময় দিতে পারে।
স্মরণকালের বৃহত্তম সভায় আজ আমি
সদর্পে ঘোষণা করছি, হে বোকা জমায়েত,
পল্টনের মাঠে আর কোনোদিন সভাই হবে না,
আজকেই শেষ সভা, শেষ সমাবেশে শেষ বক্তা আমি।
এখনো বিনয় করে বলছি, সাইরেন বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে
আপনারা এই মাঠ খালি করে দেবেন।
এই পল্টনের মাঠে আমার প্রেমিকা ছাড়া
আর যেন কাউকে দেখি না কোনোদিন।
এই সারা মাঠে আমি একা, একজন আমার প্রেমিকা।

পরানের গহীন ভিতর ৬ – সৈয়দ শামসুল হক
তোমার খামচির দাগ এখনো কি টকটকা লাল,
এখনও জ্বলন তার চোতরার পাতার লাহান।
শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,
না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?
না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,
চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,
তোমারে পরাণ দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,
আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।
হ, জানি নিজের কাছে কোন কথা থাকেনা গোপন।
দিনের দুফর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে
আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,
আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।
আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।
বুকের পাষাণ দিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।

প্রিয় কবিতার এই পাঠককে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে এত দারুণ সব কবিতা শেয়ার করার জন্য। আশা করি তার পাঠক জীবনে তিনি আরো দারুণ সব কবিতা পড়ার সৌভাগ্য পাবেন। তার জন্য শুভকামনা।
আপনিও যদি নিজের প্রিয় কবিতাটি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। আমরা সেটা ভাগ করে নেব আরো অসংখ্য পাঠকের সাথে।
আমাদের অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গী হতে চোখ রাখুন আমাদের ফেসবুক পেইজে, নিয়মিত ভিজিট করুন লণ্ঠনে। যোগ দিন শিল্পের এক নতুন উৎসবে।