জন্মদিনে স্মরণঃ শচীন দেববর্মণের জীবন ও কিছু কালজয়ী গান

জন্ম নিয়েছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারে। সবকিছু ঠিক থাকলে শচীন দেববর্মণও হতে পারতেন ত্রিপুরার রাজা। কিন্তু বিধিবাম। তার বাবা ছিলেন নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মণ- যিনি ছিলেন ত্রিপুরার রাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যের দ্বিতীয় সন্তান। রাজা ঈশানচন্দ্র মারা যাওয়ার পর তার সন্তানদেরকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন তার ভাই বীরচন্দ্র মানিক্য। তিনি নিজের উত্তরাধিকার অক্ষত রাখতে নবদ্বীপচন্দ্রকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন।

এমন অবস্থায় নবদ্বীপচন্দ্র (শচীনদেবের পিতা) ত্রিপুরার রাজবাড়ী থেকে কুমিল্লায় চলে আসেন। তারপর সিংহাসনের দাবি ত্যাগ করলে বীরচন্দ্র তাকে কুমিল্লায় ৬০ একর জমি দান করেন। এখানেই নতুন বাড়ি তৈরি করেন নবদ্বীপচন্দ্র। এই বাড়িতেই ১৯০৬ সালে ১ অক্টোবর জন্ম নেন শচীনদেব বর্মণ। জন্মের দুই বছরের মাথায় হারান মাকে।

কুমিল্লার মাটিতেই এই মাতৃহীন বালকের বেড়ে ওঠা। ১৯২০ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তারপর ভর্তি হন বিখ্যাত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। সেখান থেকেই আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ তে ভর্তি হন। কিন্তু ততদিনে তাকে গানের নেশা পেয়ে বসেছে। থাকলো তোমার এমএ ডিগ্রী, চললাম আমি গানের পথে- এমন ভঙ্গিতে নতুন যাত্রা শুরু করেন শচীনকর্তা।

গানের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল ছোটবেলাতেই। তার বাবা নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন একজন প্রখ্যাত সেতারবাদক। বাবার কাছ থেকেই তার সঙ্গীতে হাতেখড়ি। পরে কলকাতায় গিয়ে বিভিন্ন প্রখ্যাত সুরগুরুর তত্ত্বাবধানে নিজেকে ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন শচীন দেববর্মণ।

১৯২৫ সাল থেকে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণচন্দ্র দে বা কে. সি. দে-র (মান্না দে-র কাকা) কাছে সঙ্গীতের প্রথাগত তালিম নেওয়া শুরু করেন। এরপর তিনি ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, সরোদ-সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং সারেঙ্গি-বাদক ওস্তাদ বাদল খাঁ-র মতো দিকপালদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালে কলকাতা বেতার কেন্দ্রে (পরবর্তীকালে অল ইন্ডিয়া রেডিও) একজন গায়ক হিসেবে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। একই বছর তাঁর প্রথম রেকর্ডটি প্রকাশিত হয় হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে যার এক পিঠে ছিল একটি আধা-শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং অন্য পিঠে একটি লোকগীতি। 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তার ছিল বন্ধুর মতো সম্পর্ক। নজরুলের সুরে চারটি গান করেছেন তিনি, শিখেছেন এর চেয়েও বেশি। নজরুলের সান্নিধ্যে এসে শচীন দেববর্মণ শিখলেন কীভাবে লোকজ সুরের কাঁচা শক্তিকে পরিশীলিত কাব্যিক ও সাঙ্গীতিক কাঠামোতে ব্যবহার করা যায়।

১৯৪৪ সালে মুম্বাইতে গিয়ে থিতু হন ও একের পর এক হিট গান উপহার দিতে থাকেন। একজন গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক হিসেবে দিনে দিনে নিজেকেই ছাড়িয়ে যেতে থাকেন। তাঁর হাত ধরে উঠে আসেন আরেক কিংবদন্তি শিল্পী কিশোর কুমার- যাকে তিনি দ্বিতীয় পুত্র মনে করতেন।

অশোক কুমারের বাড়িতে প্রথমবার কিশোরের গান শুনে বর্মণ তাঁকে কে. এল. সায়গলের অনুকরণ করতে বারণ করেন এবং জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপদেশটি দেন: “বেটা, আপনি আওয়াজ মে গাও” (নিজের কণ্ঠে গাও) । এই একটি কথাই কিশোর কুমারকে তাঁর নিজস্ব পরিচয় খুঁজে নিতে সাহায্য করে এবং ভারতীয় সঙ্গীত জগৎ এক নতুন ও অদ্বিতীয় কণ্ঠস্বর লাভ করে।   

তিনি একই সাথে আরেক কিংবদন্তি শিল্পী মোহাম্মদ রফির সাথে মিলেও উপহার দেন অসংখ্য স্মরণীয় গান। এছাড়া লতা মঙ্গেশকারকে দিয়েও অনেক গান গাওয়ান। কিন্তু একসময় লতাজির সাথে তার কিছুটা মন কষাকষি হলে, তিনি লতার ছোট বোন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে কাজ করেন। সেই সাথে তৎকালীন গায়িকা গীতা দত্তকে নতুন করে আবিষ্কার করেন তিনি।

শচীন দেববর্মণ অজান্তেই আরও একজন কিংবদন্তিকে খুঁজে বের করেছিলেন। বিমল রায়ের বন্দিনী (১৯৬৩) ছবির সঙ্গীত পরিচালনার সময় গীতিকার শৈলেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হয়। তখন “মোরা গোরা অঙ্গ লই লে” গানটি লেখার জন্য একজন নতুন গীতিকারের প্রয়োজন হয়। শচীন বর্মণ সুযোগ দেন এক তরুণ কবিকে, যাঁর নাম ছিল গুলজার। এটিই ছিল গুলজারের হিন্দি চলচ্চিত্রে বড় মাপের প্রথম কাজ এবং শচীন দেববর্মণের সঙ্গে তাঁর একমাত্র কাজ।

পরবর্তীতে শচীন দেববর্মণের ছেলে রাহুল দেববর্মণ (আরডি বর্মণ) এর সাথে মিলে গুলজার অসংখ্য স্মরণীয় কাজ উপহার দেন। রাহুল বর্মণ পিতাকে ছাড়িয়ে যেতে না পারলেও তিনি হয়ে ওঠেন আরেক কিংবদন্তি। তাঁর সাথে বিয়ে হয় প্রখ্যাত শিল্পী আশা ভোঁসলের। আশা হন বর্মণ পরিবারের পুত্রবধূ। 

এছাড়া মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ আরো অসংখ্য শিল্পীকে অমরত্ব দিয়েছে শচীনদেবের অসাধারণ সুরের মায়া। অর্থাৎ এই কথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, শচীন দেববর্মন যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সোনা ফলিয়েছেন- শুধু এই কথাটি যথেষ্ট নয়। বরং তাকে বলা যায় একজন খাঁটি স্বর্ণকারের মত খাঁটি সোনা চিনে নেয়ার এক অদম্য প্রতিভা হিসেবে।

১৯৭৫ সালে মিলি নামক চলচিত্রের “বড়ি সুনি সুনি হ্যায়” গানটির রেকর্ডিং এর সময় বর্মণ স্ট্রোক হয়ে কোমায় চলে যান।  পাঁচ মাস কোমায় থাকার পর ৩১ অক্টোবর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শচীন টেন্ডুলকরের পিতা রমেশ টেন্ডুলকর ছিলেন শচীন দেববর্মণের একনিষ্ঠ অনুরাগী। তিনি তাঁর প্রিয় সুরকারের নামেই নিজের পুত্রের নাম রাখলেন। বড় হয়ে এই নামটি আরেকবার কিংবদন্তীর সম্মান পেলো।   

এটি প্রমাণ করে যে, তাঁর প্রভাব কেবল সঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। একজন শিল্পী যখন একটি জাতির চেতনার সঙ্গে এতটাই মিশে যান যে, একজন পিতা সেই নামটি তার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে বেছে নেন, তখন বোঝা যায় সেই শিল্পীর আবেদন কতটা সর্বজনীন।

জন্মদিনে স্মরণ করছি এই মহান শিল্পীকে। তার গাওয়া কয়েকটি অনন্য গান রইল এই আয়োজনে।

ছড়িয়ে দিন ...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *