"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
বৈশাখী প্রিয় কবিতা উৎসব – দূর্বা জাহানের সাথে

কবিতা প্রেমের রাজধানী। এই প্রেম শুধুমাত্র কপোত-কপোতীর প্রেম না। কবিতা সবার আগে মানুষকে নিজের প্রেমে মজতে শেখায়। কবিতা অসময়ে ছায়া দেয়, সুসময়ে ছায়া দিতে শেখায়। কবিতা মানুষের বুকের ভেতরের কথা বলে।
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো। মাত্র একদিনের নোটিশে এই আয়োজন আমরা করতে চেয়েছিলাম। ভয়, শঙ্কা দুটোই ছিলো। কিন্তু আপনাদের উৎফুল্ল অংশগ্রহণ আমাদের শুধু সাহস যোগায়নি, দিয়েছে অনুপ্রেরণাও। আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আমাদের এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।
আজকে থাকছে দূর্বা জাহান-এর প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আয়োজন। আশা করি তার প্রিয় কবিতাগুলো আপনাদেরও ছুঁয়ে যাবে।
নির্জন স্বাক্ষর – জীবনানন্দ দাশ
তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’—
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে;
আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে,
—আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।
রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে—
আকাশ ছডায়ে আছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।
একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা;
যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব’লে
নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে।
নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়—
পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে।
আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত।
যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে—
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে—
যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো;
জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়।
হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়;
কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত—
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।
যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার।
জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পারো তুমি;
তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু—
বাহিরের আকাশের শীতে
নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে—
ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।
জানোনাকো তুমি তার স্বাদ—
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ।
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

Tonight I Can Write (The Saddest Lines) – Pablo Neruda
Tonight I can write the saddest lines.
Write, for example, ‘The night is starry and the stars are blue and shiver in the distance.’
The night wind revolves in the sky and sings.
Tonight I can write the saddest lines.
I loved her, and sometimes she loved me too.
Through nights like this one I held her in my arms.
I kissed her again and again under the endless sky.
She loved me, sometimes I loved her too.
How could one not have loved her great still eyes.
Tonight I can write the saddest lines.
To think that I do not have her. To feel that I have lost her.
To hear the immense night, still more immense without her.
And the verse falls to the soul like dew to the pasture.
What does it matter that my love could not keep her.
The night is starry and she is not with me.
This is all. In the distance someone is singing. In the distance.
My soul is not satisfied that it has lost her.
My sight tries to find her as though to bring her closer.
My heart looks for her, and she is not with me.
The same night whitening the same trees.
We, of that time, are no longer the same.
I no longer love her, that’s certain, but how I loved her.
My voice tried to find the wind to touch her hearing.
Another’s. She will be another’s. As she was before my kisses.
Her voice, her bright body. Her infinite eyes.
I no longer love her, that’s certain, but maybe I love her.
Love is so short, forgetting is so long.
Because through nights like this one I held her in my arms
my soul is not satisfied that it has lost her.
Though this be the last pain that she makes me suffer
and these the last verses that I write for her.

প্রস্থান – হেলাল হাফিজ
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো৷
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো৷
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মতো খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিয়ো৷
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে
পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো৷
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই৷
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে!

পরাণের গহীন ভেতর ৪ – সৈয়দ শামসুল হক
আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,
ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,
ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?
অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।
আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,
বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,
এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,
এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।
মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।

হাসানের জন্য এলিজি – নির্মলেন্দু গুণ
প্রেমিকারা নয়, নাম ধরে যারা ডাকে তারা ঝিঁঝি,
তাদের যৎসামান্য পরিচয় জানা থাকা ভালো;
বলতেই মৃত্তিকারা বক্ষ চিরে তোমাকে দেখালো–;
অভ্যন্তরে কী ব্যাকুল তুমি পড়ো ডুয়িনো এলিজি ।
কবরে কী করে লেখো? মাটি কি কাগজ? খাতা?
ভালোবেসে উস্কে দিই প্রাণের পিদিম, এই নাও,
অনন্ত নক্ষত্র তুমি, অন্ধকারে আমাকে সাজাও
ফের মাতৃগর্ভে, বলো দেবদূত প্রেমিকা কি মাতা?
এইসব ঝিঁঝি পোকা, এরা কি ঈশ্বর নাকি পাখি,
উদ্বাস্তু উন্মুল মোক্ষ, যৌবনের, কোন পাত্রে রাখি?
পাপে-পুণ্যে এ পৃথিবী, এই প্রাণ তারচে অধিকে ।
আমি আছি, তুমি নেই–,এইভাবে দু’জন দু’দিকে
অপসৃত; -তাই তো নশ্বর নারী কবির বিশ্বাসে,
ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে…।

আর যদি নাই আসো – বিনয় মজুমদার
আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি ; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শনবহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে।

একটি উজ্জ্বল মাছ – বিনয় মজুমদার
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পিভূত হ’য়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমত্স্য, তুমি…তুমি…
কিংবা, দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্থ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্থলী
দীর্ঘ-দীর্ঘ ক্লান্তশ্বাসে আলোড়িত করে ;
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।

যেতে পারি তবে কেন যাবো? – শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো।
এতো কালো মেখেছি দু হাতে
এতোকাল ধরে!
কখনো তোমার ক’রে, তোমাকে ভাবিনি।
এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে : আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়
যেতে পারি
যে কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাবো?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো
যাবো
কিন্তু, এখনি যাবো না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাবো
একাকী যাবো না, অসময়ে।

স্মৃতির শহর ০১ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।
বাতাসে ছেঁড়া মেঘ, চাঁদের চারপাশে
সহসা দানা বাঁধে নীল সময়
বাইরে এসে দেখি পৃথিবী শুন্শান্
রাস্তাগুলি যেন আকাশময়।
প্রথম ডেকেছিল মধ্য কৈশোরে
পাগল করা এক ব্যথার দিন
শরীরে বেজেছিল সমর বিউগ্ল
প্রথম স্বপ্নেরা হলো স্বাধীন।
চক্ষে কেউ নেই তবুও বিচ্ছেদ
পাইনি কেন তাকে চিনি না যাকে
তখন মনে পড়ে নিশীথ-সংকেত
দুরাশা ঘুরে ফেরে নদীর বাঁকে।
শাসন বন্ধন তুচ্ছ হয়ে গেল
আমার চেনা পথ গোলক ধাঁধা
দৃষ্টি বিভ্রম সীমানা ছুঁয়ে যায়
খড়্গে কেটে দিই অলীক বাধা।
এদিকে সোনাগাছি কাচের ঝনঝনি
পেরিয়ে চলে যাই আহিরিটোলা
নতুন স্ত্ৰাণ মাখা শহর কেঁপে ওঠে
পূর্ব পশ্চিমে দুনিয়া খোলা।
এখন জেগে ওঠে কীট ও কুসুমেরা
আঁধার শুষে নেয় দিনের তাপ
জ্যোৎস্না রেণু ওড়ে, ধুলোয় হীরেকুচি
এখন ছুটি নেয় পুণ্য পাপ।
দু’পাশে গলি যুঁজি হোচট লাগে পায়
পল্কা সংসার এখানে কার?
জন্ম মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুকে
হাসি ও কান্নার সারাৎসার।
এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি
এ যেন কুহকের অজানা বীজ
এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়
হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ।
আমাকে যেতে হবে এখনো যেতে হবে
রয়েছে অশরীরী অপেক্ষায়
যেখানে ব্যাকুলতা ঢেউয়ের তালে দোলে
যেখানে ধ্বনিগুলি স্মৃতিকে খায়।
পথের রাজা এক নগ্ন মহাকাল
ধরেছে মুদারায় ডাগর গান হেঁ
তাল দণ্ডটি আকাশে তুলে ধরে
সে যেন নিতে চায় সাগর-ঘ্রাণ।
একটু নিচু হয়ে দিয়েছি সম্মান
আবার সরে গেছি অপর দিকে
পারিয়া কুকুরেরা অবাক চোখে দেখে
গাছের মতো এই মানুষটিকে।
দুদিকে মন্দির, গরাদে ভীমতালা
কালীর স্তনঘেরা পিঁপড়ে রাশি
প্রদীপে মৃদু আলো, সিঁড়িতে বেজে ওঠে
কুণ্ঠরোগিণীর শুকনো কাশি।
একলা শালপাতা আপন মনে ওড়ে
পুজোর গাঁদা ফুল ধুলোয় মাখা
একটি ঘুমাচোখ বালক হিসি করে
দেয়ালে রমণীর শরীর আঁকা।
এবারে দেখা যায় স্মশানে উৎসব
আগুন জবা রং, গুঞ্জরন
ছায়ার কোলাহল, ছায়ার ঘোরাফেরা
ব্যস্ত নিরাকার মানুষজন।
এখানে রাত নেই, এখানে দিন নেই
থেমেছে চুম্বকে আয়ুর ঘড়ি
মৃতেরা হেসে ওঠে, জীবিত উদাসীরা
হেলায় ছুড়ে দেয় পারের কড়ি।
গাঁজার বীজ ফাটে, শিবের শিষ্যেরা
বৃত্তে বসে আছে ছবির প্রায়
যমজ ত্রিভূজের চূড়ায় লাল আলো
জোনাকি ফুটে ওঠে নদীর গায়।
চোখের চেয়ে আরও অনেক বড় দেখা
দৃশ্য ঘুরে যায়, ঘোরে বাতাস
ধোঁয়ার মৃদু জ্বালা শোকের রলরোল
বাষ্প-অশ্রুতে রুদ্ধশ্বাস।
জলের কাছে যাই, সেখানে কেউ নেই
সেখানে শুয়ে আছে নদীর কায়া
আমাকে ডেকেছিল স্বপ্ন ছেড়া এক
পাহাড়-কুন্তলা গভীর ছায়া।
ছায়াও জেগে ওঠে জলের সশরীর
শহর বিস্মৃত আকাশলীনা
আমার করতল দেয় ও নেয় কিছু
জীবন কেটে যায় তাকে ভুলি না।

চৈত্রে রচিত কবিতা – উৎপলকুমার বসু
১
নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।
শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত
যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে
আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা
তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার
দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল
প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায়
কেন বা এসেছে সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,
নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে–
তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য
যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক
আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে–
সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি
এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর
নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল–ঝরে যাবে–
যদি না আমার
যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকো অসংখ্য কাটায়।
২
আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক, দৈব অনুরোধ।
যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে
যাবো দূর শূন্যপথে-তারা কেমন বান্ধব বলো
কোন্ ঘড়ি? কোন্ সূর্যরথ?
হয়ত প্রকৃত ঐ নগ্ন জলধারা–
যখন দুপুর কাপে গ্রীষ্মের নতুন সাবানে।
ওদের দৈবতা বলে আমি মানি। ওদের ঘড়ির
সমস্ত খঞ্জনপাখা লক্ষবার শোনায় অস্ফুটে—
আমার বন্ধু কি তুমি?
আমি কি তোমার?
কেন যে এখনো নই প্রাকৃতিক দুঃখজটাজাল?
আমার নিয়তি তুমি ঈর্ষা করো–আমার স্মরণে
যাও দূর তীর্থপথে, ভুল পথে–রক্তিম কাঁটায়
নিজেকে বিক্ষত করো। রোমিও–রোমিও
কেন শূন্যে মেঘলীন কম্পিত চাদর উড়ে গেলে–
অনির্বাণ, স্থির নাটকের যারা ছিল চারিত্রিক,
নেপথ্যে কুশল, প্রেম চেয়েছিল, দুঃখ,
তারা একে একে অম্লান ঝরে যায়?
তবে কি আমিও নই তেমন প্রেমিকা?
৩
বহুদিন ছুঁয়ে যায় বর্তুল, বিস্মৃত পৃথিবী
লাটিম সূর্যের তাপে নানা দেশ-বিপুল শূন্যতা–
সে যেন বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের
গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে–একদিন–শুধু একদিন।
তখন, প্রবল মুহূর্তে আমি জেনেছি অনেক–
সমুদ্র কেমন হয়। কাকে বলে দুর্নিরীক্ষ্য তরু।
আমি কেন রুগ্ন হই। তুমি দূর স্খলিত তারার
কেন বা সমাধি গড়ো বনে বনে।
অথচ আঁধারে ফিরি আমি ক্লান্ত প্রদর্শক আলো,
যারা আসে সহচর রক্ত-লাল, গমের সবুজ,
তারা কেউ ধূর্ত নয়–দয়াশীল, বিনীত ভাষায়
বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার–সমস্ত অক্ষর।’
৪
এখনি বৃষ্টির পর আমি পাবো জ্যোৎস্না-ভালোবাসা।
কেননা মেনেছি আমি শোকাকুল তুমিও বন্দিনী
অজেয় শকটে তার। কোনো কোনো রথ
একা যায় ভ্রান্ত পথে–অন্ধকারে–চালকবিহীন
যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে
যেখানে জলের মতো পরিসর, অফুরন্ত বায়ু
ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট–দীর্ণ হাহাকার
তুলেছিলে শূন্যতায় পাহাড়ের উর্বর মৃত্তিকা, তুমি দুঃখ, তুমি প্রেম,
শোনননি সতর্কবাণী। যেন স্রোত সহসা পাথরে
রুদ্ধ হল। এবং স্খলিত
বহু রথ, পদাতিক দেখে আমি মেনেছি এখন
প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালোবাসা।
৫
পৃথিবীর সব তক প্রতিচ্ছায়া খুলে দেয় বসন্তের দিনে।
যখনি তোমাকে ডাকে ‘এসো এসো বিদেহ কলুষ’,
কেন যে লুণ্ঠিত, নীল পরিধান খুলে
তুমি বালিকার স্পষ্টতায় কঁদো–
বসন্তই জানে।
তবুও আমার স্বপ্ন দুপুরের–ঘুমন্ত রাতের–
প্রবল নদীর জলে ধরে রাখে নীল যবনিকা–
সে তোমার পরিচ্ছদ, অন্তরাল, হয়ত বা
যেটুকু রহস্য আমি ভালোবাসি বালিকার কিশোর শরীরে–
এখন বিনিদ্র রাতে পুড়ে যায় সব মোমবাতি!
এবং অলেখা গান নিষ্ফলতা বয়েছিল কত দীর্ঘ দিন
সে নয় প্রেমের দুঃখ? তবু সতর্কতা
ভেঙে ফেলে সুন্দরের প্রিয় পুষ্পধার
বলেছিল, ‘এই প্রেম অন্তিমের, সমস্ত ফুলের’
৬
যেন দূর অদেখা বিদ্যুতে তুমি পুড়ে যাও
তুমি সুন্দর নিয়তি
যেন জল, ঝোড়ো রাতে জ্বলে একা বজ্রাহত তরু
তুমি সুন্দর নিয়তি
মৃতেরা নিষ্পাপ থাকে। কারা নামে—অচ্ছোদসরসী–
তুমি বিরূপ নিয়তি
রাখো দূর মেঘপটে যত ক্রোধ, অকাম কামনা
তুমি সুন্দর নিয়তি
ফিরে দাও দীর্ঘ ঝড় মদিরায় প্রাচীন কুঞ্জের
তুমি সুন্দর নিয়তি।

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস – মহাদেব সাহা
কেউ জানেনা একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর
দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন
প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল
সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস,
এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর
কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ
যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান
সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ
সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ,
তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস
যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই
মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু
দেখা যায় না;
মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস,
জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত
হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে।
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
একেকটি মানুষ নিজের
মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, হায়, কেউ জানে না!

এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না – মহাদেব সাহা
এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো ভরা দামোদর
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।

প্রিয় কবিতার এই পাঠককে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে এত দারুণ সব কবিতা শেয়ার করার জন্য। আশা করি তার পাঠক জীবনে তিনি আরো দারুণ সব কবিতা পড়ার সৌভাগ্য পাবেন। তার জন্য শুভকামনা।
আপনিও যদি নিজের প্রিয় কবিতাটি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। আমরা সেটা ভাগ করে নেব আরো অসংখ্য পাঠকের সাথে।
আমাদের অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গী হতে চোখ রাখুন আমাদের ফেসবুক পেইজে, নিয়মিত ভিজিট করুন লণ্ঠনে। যোগ দিন শিল্পের এক নতুন উৎসবে।