"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
বৈশাখী প্রিয় কবিতা উৎসব – খালিদ আজাদের সাথে

কবিতা প্রেমের রাজধানী। এই প্রেম শুধুমাত্র কপোত-কপোতীর প্রেম না। কবিতা সবার আগে মানুষকে নিজের প্রেমে মজতে শেখায়। কবিতা অসময়ে ছায়া দেয়, সুসময়ে ছায়া দিতে শেখায়। কবিতা মানুষের বুকের ভেতরের কথা বলে।
পহেলা বৈশাখ ১৪৩২ উপলক্ষে আমরা জানতে চেয়েছিলাম আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো। মাত্র একদিনের নোটিশে এই আয়োজন আমরা করতে চেয়েছিলাম। ভয়, শঙ্কা দুটোই ছিলো। কিন্তু আপনাদের উৎফুল্ল অংশগ্রহণ আমাদের শুধু সাহস যোগায়নি, দিয়েছে অনুপ্রেরণাও। আপনাদের প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আমাদের এই আয়োজন অব্যাহত থাকবে।
আজকে থাকছে খালিদ আজাদ -এর প্রিয় কবিতাগুলো নিয়ে আয়োজন। আশা করি তার প্রিয় কবিতাগুলো আপনাদেরও ছুঁয়ে যাবে।
নষ্ট হব, হবে? – আখতারুজ্জামান আজাদ
আর হব না শুদ্ধ আমি, চাই নে কেহ শুদ্ধ হোক;
শুদ্ধ হবার সকল দুয়ার একে একে রুদ্ধ হোক!
নষ্টসাগর উঠুক ফুঁসে, কাঠফাটা হোক শুদ্ধ নদ;
চায়ের কাপটি করুক দখল নাম-না-জানা নষ্ট মদ!
নষ্ট জীবন, নষ্ট আগুন, শুদ্ধসাধু সিদ্ধ হোক;
নষ্ট ধনুক, নষ্ট তীর, সাধ্বীরা সব বিদ্ধ হোক!
নষ্ট হোক গান-কবিতা, নষ্ট হোক শুদ্ধ ঠোঁট;
চুমুর বদল শরাব খাব, মাতাল-মাতাল ঐক্যজোট!
কষ্ট দেব, কষ্ট নেব, একপৃথিবী কষ্ট হব;
সাধুসকল সরে দাঁড়াও, এবার আমি নষ্ট হব!
অবাকপ্রেমের মিলবে দেখা নষ্ট হলেই তবে;
একপৃথিবী, এক আহ্বান — নষ্ট হব, হবে?

এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না – মহাদেব সাহা
এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর
… কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।

আমরা নিখুঁত নই – রণজিৎ দাশ
আমরা নিখুঁত নই। একটা ঘাসফড়িং নিখুঁত, একটা সন্ধ্যাতারা নিখুঁত, একটা বৃষ্টির ফোঁটা নিখুঁত। নিখুঁত একটা বসন্তের রাত। কিন্তু আমরা জন্ম থেকেই পঙ্গু, বেঢপ, মূর্খ এবং দিশাহারা। আমরা ধূর্ত, জালিয়াত, ভঙ্গুর, ভিখারি। আমরা জন্মাই শুধু ভুল স্বপ্নে ভুল কামে ভুল শহরে হেঁটে নিজেদের ধ্বংস করার জন্য, ভুল মানুষকে ভালবেসে এবং আঘাত পেয়ে, বুক ভেঙে মরে যাওয়ার জন্য। শুধু, সবশেষে টের পাই, আমাদের ভুলগুলি কি মারাত্মক নিখুঁত।

যাতায়াত – হেলাল হাফিজ
কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেউ বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম
শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

মনে থাকবে? – আরণ্যক বসু
পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু’জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক’রে দুচোখ ভ’রে থাকবো চেয়ে…
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?
আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো
মনে থাকবে?

স্ববিরোধী – নির্মলেন্দু গুণ
আমি জন্মেছিলাম এক বিষণ্ন বর্ষায়,
কিন্তু আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত ।
আমি জন্মেছিলাম এক আষাঢ় সকালে,
কিন্তু ভালোবাসি চৈত্রের বিকেল ।
আমি জন্মেছিলাম দিনের শুরুতে,
কিন্তু ভালোবাসি নিঃশব্দ নির্জন নিশি ।
আমি জন্মেছিলাম ছায়াসুনিবিড় গ্রামে,
ভালোবাসি বৃক্ষহীন রৌদ্রদগ্ধ ঢাকা ।
জন্মের সময় আমি খুব কেঁদেছিলাম,
এখন আমার সবকিছুতেই হাসি পায় ।
আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম,
এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি ।

প্রিয় কবিতার এই পাঠককে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাথে এত দারুণ সব কবিতা শেয়ার করার জন্য। আশা করি তার পাঠক জীবনে তিনি আরো দারুণ সব কবিতা পড়ার সৌভাগ্য পাবেন। তার জন্য শুভকামনা।
আপনিও যদি নিজের প্রিয় কবিতাটি আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চান, পাঠিয়ে দিন আমাদের কাছে। আমরা সেটা ভাগ করে নেব আরো অসংখ্য পাঠকের সাথে।
আমাদের অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গী হতে চোখ রাখুন আমাদের ফেসবুক পেইজে, নিয়মিত ভিজিট করুন লণ্ঠনে। যোগ দিন শিল্পের এক নতুন উৎসবে।