"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
গ্রাফিতি কি ও কেন: এক নজরে গ্রাফিতির দুনিয়া

কল্পনা করুন, আপনি রাস্তা ধরে হাঁটছেন। হঠাৎ ফুটপাতের পাশের দেয়ালে আঁকা কিছু একটা আপনার নজর কাড়লো। বড় করে আঁকা ছবিটাতে আছে একটা সৃজনশীলতার ছাপ, সাথে প্রতিবাদের দু-একটা পংক্তি। আরো ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেখানে লুকিয়ে আছে একটা গল্প। সর্বশক্তিমান অপশক্তির বিরুদ্ধে অসহায় মানুষের গল্প এটা। সাথে সাথেই আপনার মনে হলো, ‘আরে হ্যাঁ, তাইতো, এটা তো আমারও গল্প। আমিও তো নিপীড়িত।’ আর তখনই আপনি বোধ করলেন, এই ধূ ধূ অস্থির পৃথিবীতে আপনি একেবারেই একা না। বরং অধিকাংশ মানুষই আপনার আর আমার মতো- আমাদের ধাপে ধাপে শোষন করে চলে মহাজনদের দল।
ঐ দেয়াল তখন শুধু আর একটা নিছক দেয়াল না। ইট-পাথরের দেয়ালটা তখন যেন জীবন্ত একটা মনুমেন্ট হয়ে উঠেছে যার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের ছুঁয়ে যাবে সেই অদৃশ্য শক্তি, দেবে সাহস একটা নতুন দিনের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আপনার বুক ভরে উঠেছে এক অদ্ভুত আশার নিঃশ্বাসে। এখন আর আপনি আগের মতো দুর্বল বোধ করছেন না। আপনার মনে হচ্ছে কাছেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে আপনার বন্ধুরা- আরো সব নিপীড়িত মানুষেরা। যেন আপনার উপর কেউ আঘাত করলে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়বে আঘাতকারীদের উপর। এই পৃথিবী সবার। আপনারও। একটা ফুরফুরে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনি হেঁটে চলে যান।



আপনাকে গ্রাফিতির দুনিয়ায় স্বাগতম। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন গ্রাফিতি কি। গ্রাফিতি হচ্ছে দেয়ালে আঁকা ছবি বা লেখা। তবে যেমন তেমন ছবি গ্রাফিতি না। যেমন শিক্ষক নিয়োগ, কোচিং সেন্টার, হাতের লেখা সুন্দর করে- এই সব বিজ্ঞাপন গ্রাফিতি না। তাহলে গ্রাফিতি কি? গ্রাফিতি কি আর্ট? নাকি এটা ভ্যান্ডালিজম বা ধ্বংসাত্মক আচরণ? এটা নির্ভর করে কে কথা বলছে তার উপর।

গ্রাফিতি কি? ও কেন?
বড় বড় অপশক্তির কাছে সাধারণ মানুষ সবসময় জিম্মি। এই পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি অসহায় আর কেউ হয় না। তার রক্তের দাম নাই, তার জীবনের দাম নাই, সে যেন বেঁচে আছে শুধুমাত্র অসুস্থ এক সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তার মৃত্যুতেও এই চক্র ভাঙে না। তার পরবর্তী প্রজন্ম তার জায়গা নেয়- এভাবে যেন এক অনন্ত অসীম দোজখের তাপে জ্বলতে হচ্ছে যুগের পর যুগ। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে সাধারণ মানুষের এই আর্তনাদ শোনারও কেউ নেই। তারা অসংখ্য, অনেক, কিন্তু একা। পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকলেও তাদের কথা শোনার কেউ নেই। আর ঠিক এই জায়গাটাতেই গ্রাফিতির আবির্ভাব।
গ্রাফিতি হচ্ছে একটা শক্তিশালী স্ট্রিট আর্ট যেটা অধিকাংশ সময় ভালোবাসা, প্রতিবাদ ও আশার কথা বলে। রঙ-কালি দিয়ে মৃত জড় দেয়ালে অবহেলিত মানুষের জীবন্ত আর্তনাদ বা দীর্ঘশ্বাস এঁকে দেয় গ্রাফিতি। যাদের কথা শোনার কেউ নেই, সেইসব তাদের গল্প গ্রাফিতি হয়ে যায় দেয়ালে।
গ্রাফিতির ইতিহাস
দেয়ালে আঁকাআঁকি যদি গ্রাফিতি হয় তাহলে প্রাগৈতিহাসিক কালের গুহাচিত্রগুলিকেও গ্রাফিতি বলা যায়। এছাড়া প্রাচীন গ্রীক, রোমানসহ প্রায় বড় বড় সব সভ্যতাতেই নগরের দেয়ালে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি কবিতার লাইন, রাজনৈতিক সংলাপ, নকশাকার ছবি এগুলোর অস্তিত্ব ছিলো। এছাড়া হাল আমলে আমাদের ১৯৫২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বড় ছোট প্রায় সকল আন্দোলনে গ্রাফিতির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।

তবে গ্রাফিটির আধুনিক ইতিহাস শুরু হয় মূলত ১৯৬০ দশকে ফিলাডেলফিয়াতে। ড্যারিল ম্যাকক্রেকে (Darryl McCray) মডার্ন গ্রাফিতির জনক ধরা হয়। তিনি কর্নব্রেড (Cornbread) ছদ্মনামে পরিচিত। কর্নব্রেড হচ্ছে এক ধরণের পাউরুটি যা ভূট্টার আটা থেকে বানানো হয়। আর তার এই গ্রাফিতির শুরুটাও বেশ অন্যরকম। জানা যায়, তিনি ভালবাসতেন সিনথিয়া নামের এক মেয়েকে। কিন্তু সেই মেয়েকে তো বলতে পারছেন না। তাই তিনি এলাকার রাস্তাঘাট সবখানে ‘কর্নব্রেড সিনথিয়াকে ভালোবাসে’ এই লিখে লিখে ভরে ফেললেন, আর নিজের অজান্তেই যাত্রা শুরু করালেন এক নতুন আর্ট ফর্মের।



এরপরে গ্রাফিতি পৌঁছে যায় নিউইয়র্কে। ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে নিউইয়র্কের সাবওয়ে থেকে শুরু করে শহরের প্রায় সর্বত্র ছেয়ে যায় গ্রাফিতিতে। নতুন নতুন গ্রাফিতি শিল্পীর আগমন ঘটে যারা আগের চেয়ে অনেক বেশি চৌকস, মেধাবী ও নির্ভীক। একটা সময় এমন হয় যে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে দেখার উপায় নাই গ্রাফিতির কারণে। তখন নিউইয়র্কের মেয়র গ্রাফিতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, আর ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। কিন্তু তাতেও থামানো যায় না এসব ‘রাস্তার শিল্পীদের’। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘বাঙ্কসি’ (Banksy) যিনি কীনা পরিণত হয়েছেন এক কিংবদন্তীতে। এই গেরিলা আর্টিস্টকে নিয়ে থাকছে আমাদের পরবর্তী আয়োজন।
বিশ্বের সেরা কিছু গ্রাফিতি
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে অসংখ্য অসংখ্য গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে। এগুলো আকার ধরণে যেমন রয়েছে বৈচিত্র্য, তেমনি একেক শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় একেক ভাবে বেড়ে উঠেছে এই শিল্পটি। এত সব আশ্চর্যজনক, ভয়াবহ সুন্দর, বৈচিত্র্যময় গ্রাফিতির কিছু কিছু এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
Mural das Etnias / Eduardo Kobra / Rio de Janeiro

Half Rabbit / Bordalo II / Gaia

Kids on Bicycle / Ernest Zacharevic / George Town

Carnival Nymph / Isidora López Paz / Aruba

The Little Girl with the Balloon / Banksy / London

We the Youth / Keith Haring / Philadelphia

Coexist / Combo / Jerusalem

The Flower Thrower / Banksy / Wall between Israel and Palestine

We’re All in the Same Boat / Banksy / Suffolk

Subodh Tui Paliye Ja / Hobeki / Dhaka

গ্রাফিতি নিয়ে, বাঙ্কসিকে নিয়ে, কিংবা বাংলা গ্রাফিতি নিয়ে পরবর্তী আয়োজনগুলোতে থাকছে আরো অনেক না জানা কথা কিংবা ইতিহাস।
দারুন এই আর্ট ফর্মটিকে নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজনগুলো দেখতে সাথেই থাকুন।