"সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও মূল্য দিতে হয়- সেটা হচ্ছে তোমার মনোযোগ।"
কানা বগীর ছা ও একজন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন

প্রথম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বইতে আমাদের পড়া প্রথম ছড়া/কবিতা ছিল ‘কানা বগীর ছা’। তখনকার পাঠ্য বইগুলো এখনকার মত এত রঙবেরঙের ছিল না। একটাই গোলাপি ধরণের রঙ ব্যবহার করা সেই সহজ সরল ছবিগুলো এখনও মনের পাতায় লেগে আছে।
বিলের ধারে দুটি ছেলে মেয়ে। একটু দূরে পানিতে একটা বকের (কানা বগীর ছা) মুখে একটা মাছ ধরা- এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনে আরো কিছু দূরে বিলের ধারে একটা তালগাছ। আরো দূরে ঘরবাড়ি-গাছপালা-গ্রাম। আর বাকি অর্ধেক পৃষ্ঠা জুড়ে একটা ছড়া- কানা বগীর ছা। লিখেছেন খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন।
কানা বগীর ছা
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন
ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাগের গাঁ
ঐ খানেতে বাস করে
কানা বগীর ছা।
ও বগী তুই খাস কী?
পানতা ভাত চাস কি?
পানতা আমি খাই না
পুঁটি পাছ পাই না
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।

৯০ এর দশকে বাংলা পাঠ্যপুস্তকগুলো ছিলো স্বপ্নের মতোন। ‘আমার বাংলা বই’ নামের পাঠ্যবইয়ে এই কবিতা পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু আমাদের শৈশব রাঙিয়ে তোলা এই খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন আসলে কে ছিলেন? কতটুকু জানি আমরা তাঁকে নিয়ে?
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন (১৯০১-১৯৮১)। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নাম। যে লোকটা তার জাদুকরী ছন্দ দিয়ে ছিলেন রাঙিয়েছিলেন আমাদের শৈশব, অথচ তাঁর নিজের ছোটবেলা কেটেছে অত্যন্ত দুর্দশায়। অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে বেছে নিয়েছিলেন কিশোর শ্রমিকের জীবন। তবু তার ছিল অপরিসীম জীবনীশক্তি। নিজের যোগ্যতায় হয়ে উঠেছিলেন সমকালীন সাহিত্যের এক কিংবদন্তিতে। এমনকি জেলেও যেতে হয়েছিলো তাকে।

মা-বাবার মৃত্যু | কঠিন শৈশব
খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন ১৯০১ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার চারিগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মুহম্মদ মমরেজ উদ্দীন খান ও মায়ের নাম রাকিবুন নেসা খানম। বাবা মায়ের সাথে ছিলো ছোট্ট সংসার। সব ঠিকঠাক মতোই চলছিলো। তখনই হঠাৎ ঝড়। মাত্র ৯ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় তাঁর মা মারা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ না। এর ৩ বছর পর বাবাও চলে যান। একেবারে এতিম হয়ে পড়েন শিশু মঈনুদ্দীন। এমনকি পিতামাতার রেখে যাওয়া তেমন কোনো জমিজমা বা সম্পদও ছিলো না। এত অল্প বয়সেই পৃথিবীর চোখ রাঙানি। অসহায় কিশোর জীবিকার খোঁজে কলকাতায় চলে গেলো। সেখানে চাকরি নিলো বই বাঁধাই করার কাজে। শুরু হলো এক নতুন সংগ্রাম।
অদম্য প্রতিভা
দারিদ্র ও সংগ্রামের জীবনেও তার আনন্দ ছিল বই পড়ায়। পড়তে ভালোবাসতেন। পড়ালেখার প্রতি তাঁর তুমুল আগ্রহ। কাজের পাশাপাশি ভর্তি হন একটি নাইট শিফট স্কুলে। দিনে বই বাঁধাইয়ের কাজ, রাতে স্কুল। এই হলো মঈনুদ্দীনের নতুন জীবন।
ছোটবেলা থেকেই ছড়া-কবিতা লেখার অভ্যাস ছিলো তাঁর। সাহিত্যে অগাধ আগ্রহ। কৈশোর পেরোতেই হাতে লিখে প্রকাশ করে ফেলেন দেয়াল পত্রিকা ‘মুসাফির’। এই দেয়াল পত্রিকা প্রকাশের পর তিনি আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। লেখা পাঠাতে শুরু করেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ১৯২১ সালে তার লেখা ‘খোদার দান’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় মাসিক ‘সহচর’ পত্রিকায় যা তাঁকে আরো সাহস যোগায়। তিনি হাত খুলে একাগ্রচিত্তে লেখালেখি শুরু করেন। অল্পদিনেই তার প্রতিভা আরো আলো ছড়াতে শুরু করলো।
নজরুলের সাথে সখ্যতা, কারাবরণ
১৯২০ সাল। কাজী নজরুল ইসলাম তখন ‘নবযুগ’ নামের একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা শুরু করেছেন। একদিন ‘নবযুগ’ পত্রিকা অফিসে গিয়ে নজরুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ান ১৯ বছরের খান মুহাম্মাদ মঈনুদ্দীন। তাঁর নিজের ভাষায়ঃ
কবি আগামীকালের জন্য কপি তৈরি করছিলেন। মৃদু পদক্ষেপে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি মাথা তুলে আমার মুখের দিকে তাকালেন। বললেন: “কি চাই আপনার?”
সূত্রঃ যুগস্রষ্টা নজরুল/খান মুহাম্মাদ মঈনুদ্দীন
আমি তখন কিশোর। সাহিত্যিকদের সাথে আলাপের ঔৎসুক্য নিয়ে এ-অফিস, ও-সমিতিতে ঢুঁ মারি। এখানে এই নতুন পরিবেশে এসে বুক দুরু দুরু কাঁপছে। কেমন করে বলবো! কি চাই আমার? একটু ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললাম--“এই–এই–আমি হচ্ছি আপনাব লেখার একজন ভক্ত। দেখতে এলাম আপনাকে।”
হো হো করে কবি হেসে উঠলেন। সে কী বিরাট হাসি। একখানা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন বসতে। আর হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যাণ্ডশেক করবার জন্য।
হাতে হাত দিলাম। তুলোর মত নরম সুন্দর হাত। কিন্তু শিরায় শিরায় আমার যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। তার মনের বলিষ্ঠতা আর যুদ্ধ-ফেরত রাইফেল-ধরা হাতের ইলেক্ট্রিসিটি কি আমার সমগ্র দেহে আর মনের পরতে পরতে এক অপূর্ব পুলকের সৃষ্টি করলো?
এরপর তার সাথে আমার আরও কয়েকবার দেখ! হয়েছিল “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতি’র অফিসে।
নজরুলকে দেখে, কথা বলে ভীষণ মুগ্ধ হন এই কবি। দু’জনের মধ্যে জন্ম নেয় সখ্যতা- যা পরবর্তীতে এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নেয়।

১৯২২ সাল। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলো। আর সাথে সাথেই ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয় ও প্রহসনের বিচারে তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়।
এদিকে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনও ‘মুসলিম- জগৎ’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহ’ নামের সম্পাদকীয় লিখে গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকার তাকেও ছ’মাসের কারাদণ্ড দিয়ে হুগলি জেলে পাঠিয়ে দেয়। এখানেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর আবারো দেখা হয়। এই জেলে থাকাবস্থায় তাঁদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। তাদের এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল নজরুলের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
আনন্দময়ীর আগমনে
কাজী নজরুল ইসলাম
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার 'ময়-ভুখা-হু'র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..
'ময় ভুখা হুঁ মায়ি' বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
১৯২২ সাল। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় ও বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়। এদিকে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনও ‘মুসলিম- জগৎ’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহ’ নামের সম্পাদকীয় লিখে গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকার তাকে ছ’মাসের কারাদণ্ড দিয়ে হুগলি জেলে পাঠিয়ে দেয়। এখানেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর আবারো দেখা হয়। নজরুল তখন অনশন করছিলেন। জেলে থাকাবস্থায় তাঁদের দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। তাদের এই বন্ধুত্ব অটুট ছিল নজরুলের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
পরবর্তীতে নজরুলের জীবনের বিভিন্ন ধাপে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে আছেন কবি খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন। নজরুল-প্রমিলা দেবীর বিয়ের অন্যতম সাক্ষীও ছিলেন তিনি। সাক্ষী ছিলেন নজরুলের ছেলে বুলবুল মারা যাওয়ার সময়েরও।
এত কাছ থেকে নজরুলকে দেখার সৌভাগ্য খুব অল্প মানুষেরই হয়েছে। কাজী নজরুলকে নিয়ে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ নামের এক অনন্য সাধারণ জীবনীগ্রন্থ। কাজী নজরুলকে নিয়ে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ পাওয়া যায় ‘যুগস্রষ্টা নজরুল‘ এর মাঝে প্রথম শ্রেণির। এই বই নজরুল গবেষকদের কাছে আজো হীরার মতো দামি এক অমর সৃষ্টি। নজরুলকে আরো ভালোভাবে, আরো গভীর থেকে চিনতে এই গ্রন্থটি এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটা শুধুই এক জীবনীগ্রন্থ নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু- দুই কবির বন্ধুত্বের অবিস্মরণীয় স্মারক।
কর্মজীবন ও শিশুসাহিত্যে মনোনিবেশ
খান মঈনুদ্দীন কর্মজীবনে কলকাতা কর্পোরেশন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০ বছর এখানেই শিক্ষকতা করেন। বাচ্চাদের পড়াতে গিয়েই শিশুসাহিত্যের প্রতি একটা তাগাদা অনুভব করেন।
যে মধুর শৈশব তিনি পাননি, শিশুদের সবচেয়ে সেই সুন্দর সময়টুকুই তিনি রাঙিয়ে দিতে থাকেন পরম মমতায়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিশু সাহিত্য তাঁর হাত ধরে হয়ে ওঠে আরো রঙিন, আরো প্রাণবন্ত।
ঢাকাবাস ও প্রকাশনী প্রতিষ্ঠা ও ‘৭১
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশবিভাগের পর খান মঈনুদ্দীন ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকার বাংলাবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলহামরা লাইব্রেরি’ নামের একটি প্রকাশনী।
১৯৭১ সালে হানাদাররা যখন সারাদেশে পৈশাচিক নির্যাতন চালাচ্ছিল, তখন কবি তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখে রাখছিলেন তার ভাবনা, অভিজ্ঞতা- যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক প্রামাণ্য দলিল।
প্রথমবারেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্তি
১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার চালু করা হয়। প্রথম বছরেই ফররুখ আহমদ, আবুল মনসুর আহমদদের সাথে এই পুরস্কার পান খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন। এছাড়া তিনি ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০) এবং একুশে পদক (১৯৭৮) লাভ করেন।



খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের লেখাগুলো সহজ, সরল, মনোমুগ্ধকর। তাঁর লেখা শিশুমনে সহজেই দাগ কাটে। অমর এই সাহিত্যিক অনেক কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। তবু তিনি শিশুদের জন্য তাঁর সৃষ্টি করা অমূল্য মণিমুক্তাগুলোর জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন।
১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শিশু সাহিত্যিক খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও বাংলার শিশু-কিশোরদের হৃদয়ে তিনি প্রিয় শৈশবের মতোই পরম যত্নে বেঁচে থাকবেন আরো অনেকদিন।